সম্প্রতি রাজধানীর ধানমণ্ডি লেকের পাশে দেখা মিলেছে ব্যতিক্রম এক দৃশ্য, ছোট ছোট বাক্সে শোভা পাচ্ছে বই আর বই। দেখতে ঠিক যেন পোষা পাখির ঘরের মতোই। লেকে আসা দর্শনার্থীদেরও আকৃষ্ট করছে এসব বইয়ের বাক্স। বই পড়াকে সহজ করার সুন্দর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন অনেকেই। লেকে আগতরা বলছেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরের পার্কগুলোতেও এমন উদ্যোগ নেওয়া হলে বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে। পাঠকরাও উপকৃত হবেন। আসলে জ্ঞানার্জন এবং অবসর সময় কাটানোর উৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে বই পড়া। কিন্তু সাধারণত বই থাকে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মোট জনসংখ্যার তুলনায় লাইব্রেরির সংখ্যা খুবই কম। বিপুল জনসংখ্যার বিপরীতে কমসংখ্যক লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা আরও কম। এসব লাইব্রেরি মূলত শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক। কিন্তু সাহিত্যচর্চা এবং তা থেকে জ্ঞান আহরণে যে কেউ লাভবান হতে পারে যে কোনো বয়সে। রবীন্দ্র-নজরুল কেউই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু তারা সাহিত্যের পণ্ডিত ছিলেন। তাদের রচিত বই নিম্ন শ্রেণি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে। হচ্ছে গবেষণাও। দেশে সাধারণ তথা আমজনতার জন্য লাইব্রেরি নেই বললেই চলে। এ নিয়ে কেউ কোনোদিন আপত্তি করেনি। আবার তেমন কোনো উদ্যোগও লক্ষ্য করা যায়নি। তাই বলে এতদিন যা হয়নি তা এখন কিংবা ভবিষ্যতে হবে না, তা কিন্তু নয়।
বর্তমান পরিবর্তিত সংস্কারে সর্বস্তরের জনগণের জন্য অবসর সময়ে বই পড়ার আন্দোলনকে সংযুক্ত করা যেতে পারে। দেশের সিংহভাগ লোকই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায় না। দরিদ্রতা, বাল্যবিয়ে, অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরাসহ নানাবিধ কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে অনেকেই বঞ্চিত। আবার যারা অল্প শিক্ষিত, শুধু লিখতে-পড়তে পারে অথচ কর্মব্যস্ততার কারণে এবং সময় ও সুযোগের অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়া কিংবা জ্ঞানচর্চার সুযোগ পায় না, তাদের জন্য ব্যাপক হারে গণগ্রন্থাগার কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা ভাবা যেতে পারে। ধানমণ্ডির লেকের আদলে দেশের সমস্ত পার্কগুলোকে এই সংস্কারের আওতায় আনা যেতে পারে। এছাড়া শহর-বন্দর-গ্রাম নির্বিশেষে মানুষের যাতায়াতের জন্য আছে অসংখ্য যাত্রী ছাউনি। বাস, লঞ্চ, ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়া কিংবা আসার প্রচলন এখনো তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি আমাদের দেশে। যাত্রীরা এসব স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও পরিচালনার অভাবে এখানে শুধু পান/বিড়ি/সিগারেটের দোকান থাকে। থাকে ফকির, মিসকিন, পাগল, মানসিক বিকারগ্রস্ত, নেশাগ্রস্ত ও হকারের দখলে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নেই বললেই চলে। উন্নত দেশের এসব যাত্রী ছাউনিতে টাঙানো থাকে পরিবহন আসা-যাওয়ার সময়সূচি। থাকে পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিনসহ নানাবিধ গল্পের বইয়ের একটি মিনিস্টল। পরিবহন না আসা পর্যন্ত যাত্রীরা ওই স্টল থেকে বিনামূল্যে এসব বই, ম্যাগাজিন পড়ে এবং যাওয়ার সময় যথাস্থানে রেখে যায়। ইচ্ছা করলে কিনেও নিতে পারে। অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কোলাহলমুক্ত ও সুশৃঙ্খল একটি পরিবেশ। ওইসব দেশের আদলে আমরাও এ রকম উদ্যোগ নিতে পারি।
রাস্তা, লঞ্চঘাট ও রেলস্টেশনের পাশে থাকা যাত্রী ছাউনিগুলো সাধারণত সরকারের আওতাধীন বিভিন্ন ইজারাদারের মাধ্যমে বার্ষিক চুক্তিতে পরিচালিত হয়। এসব যাত্রী ছাউনিতে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হলে দরকার ইচ্ছা, আন্তরিকতা ও পরিকল্পনা। তাহলে কে নেবে উদ্যোগ? সরকারের পাশাপাশি উদ্যোগ নিতে পারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পেনশনভোগী অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সমাজসেবী, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন এমনকি বিদেশী প্রতিষ্ঠানও। সড়ক, নৌ ও রেলযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পরিকল্পিত মাস্টার প্ল্যান করা যেতে পারে। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে নগর-অঞ্চল পরিকল্পনাবিদরা।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালু হয় দেশের চারটি বড় শহর- ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে। আজ ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি দেশের প্রায় সব জেলা এবং উপজেলায় বিস্তার লাভ করেছে। এ লক্ষ্যে প্রথমেই ঠিক করে নিতে হবে যাত্রী ছাউনির সঠিক সংখ্যা এবং তা নিবন্ধিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার মালিকরা এখানে সৌজন্য সংখ্যা পাঠাবে। প্রকাশকরাও তাদের বইয়ের মার্কেটিংয়ের জন্য কিছু বই এখানে রাখবেন। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিও অনুদান হিসেবে নিজেদের প্রকাশিত বই, যা সমাজ উন্নয়নে সহায়ক, এখানে রাখতে পারেন। দেশে আছে অসংখ্য গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী জনবল। সুষ্ঠুভাবে এসব গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য নিয়োগ করা যেতে পারে তাদের। যে দায়িত্বে থাকবে তিনি পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতাসহ রক্ষণাবেক্ষণের সার্বিক দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের একটি বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেবে। ফলে, বেকারত্ব কমবে এবং সংশ্লিষ্ট কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।
অনেকেই হয়তো বলবেন ইন্টারনেটের এ যুগে গুগল সার্চ করে যে কোনো তথ্যই খুব সহজে পাওয়া যায়। অথচ ইংরেজ লেখক নীল গাইমান বলেছেন, ‘গুগল হয়তো আপনাকে এক লাখ উত্তর দিতে পারে, কিন্তু একজন লাইব্রেরিয়ান আপনাকে সঠিক উত্তরের সন্ধান দিতে পারে।’ বিখ্যাত মার্কিন লেখক ও চিত্রনাট্যকার রে ব্র্যাডবারি বলেছেন, ‘গ্রন্থাগার ছাড়া আমাদের কী আছে? আমাদের না আছে অতীত, না আছে ভবিষ্যৎ’। ‘বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রাবন্ধিক, কবি ও লেখক প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বলেছেন, সাহিত্যচর্চা শিক্ষার প্রধান অঙ্গ এবং সাহিত্যচর্চার জন্য বই বা লাইব্রেরি অপরিহার্য। তাই তিনি লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপর স্থান দিয়েছেন। গ্রন্থাগার মানুষকে নতুন ধারণা, জ্ঞান অর্জন, চাকরির অনুসন্ধান এবং বিশেষত চমৎকার সব গল্পের জগতে হারিয়ে যেতে সাহায্য করে। গণতন্ত্রের সাফল্যেও গ্রন্থাগারের ভূমিকা রেডিও, টেলিভিশন কিংবা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার চেয়ে কম নয়। এ লক্ষ্যে এসব লাইব্রেরিতে একটি বড় ডিজিটাল মনিটর রাখা যেতে পারে। যেখানে সরকারি প্রজ্ঞাপন, নির্দেশনা, নাগরিক সেবামূলক বার্তা, আবহাওয়ার পূর্বাভাসসহ নানাবিদ জরুরি হেডলাইন প্রদর্শিত হতে পারে। আসলে একটি জ্ঞানদীপ্ত আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে গ্রন্থাগারের বিকল্প নেই। গ্রন্থাগার আলোকিত মানুষ তৈরি করে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যেভাবে ফেসবুক, টুইটার, টিকটক ইত্যাদি আধুনিক ডিজিটাল অ্যাপসের দিকে ঝুঁকে বসেছে, সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে এসব লাইব্রেরি যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থাগার কেবল বইয়ের কোনো সংগ্রহশালা নয়, কিংবা শুধু সমাজ সংস্কারের কাজই করে না, এটি সমাজের একটি দর্পণ এবং সামগ্রিক সমাজ বিকাশের স্থায়ী উপকরণ হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
ধানমণ্ডি লেকের পাশে বইয়ের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগটি নিয়েছেন জাকিয়া রায়হানা রূপা। সমাজ সংস্কারে তার এই উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয় এবং অনুকরণীয়। উদ্যোগটিকে এগিয়ে নিতে অনেকেই হয়তো আগ্রহ প্রকাশ করবে। তবে জরুরি বিষয় হলো, বইগুলো এখন সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ হয় কিনা তা খেয়াল রাখার বিষয়। দুষ্কৃতকারীরা বইগুলো নিয়ে যায় কিনা কিংবা বইয়ের স্থলে অন্য কিছু, বিশেষ করে উস্কানিমূলক লিফলেট বা পণ্যের বিজ্ঞাপন রাখে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। অসম্ভব কিছু নয় যে কোনো নেশাখোর ব্যক্তি বইয়ের বক্সটি কোনো ভাঙ্গাড়ির দোকানে বিক্রি করে দিতে পারে। বাক্সের চতুর্দিকে সাইন পেন দিয়ে অরুচিকর লেখাও লিখতে পারে। কারণ, বাস ও ট্রেনের সিটের পিছনে শুধুই অশ্লীল প্রেমপত্র, আবেদন-নিবেদন এবং মোবাইল নম্বর দেখা যায়। বিভিন্ন স্টেশনের শৌচাগারের চার দেওয়াল যেন শুধুই সাহিত্য ও কবিতা রচনার স্থান। ল্যাম্প পোস্টগুলোতো বোঝাই যায় না যে, এটি লোহার বা স্টিলের তৈরি, শুধু বিজ্ঞাপনে ঠাসা। জাকিয়া রায়হানা রূপার নতুন এই উদ্যোগটি যাতে সেরকম পর্যায়ে না পৌঁছে, তা খেয়াল রাখতে হবে। পরিশেষে, বই পড়লে বুদ্ধি বাড়ে, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে, নেতিবাচক চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। বই পড়লে ধৈর্যশক্তি বাড়ে, শৃঙ্খলিত হতে সহায়তা করে। পক্ষান্তরে, জ্ঞান পিপাসা মেটানোর উপযোগিতার তুলনায় বইয়ের দাম খুবই তুচ্ছ। এতে যে অর্থ ব্যয় হয় তা অর্জিত জ্ঞানের তুলনায় খুবই নগণ্য। তাই জ্ঞানার্জনে বই সংরক্ষণ এবং পড়ার নতুন এই সংস্কৃতিটি বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারলেই জাকিয়া রায়হানা রূপার উদ্যোগটি হবে সার্থক।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়