জুলাই অভ্যুত্থান হলো শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণির মানুষের সম্মিলিত এক জাগরণ, যা দীর্ঘ ১৫ বছরের পর্বতসম আধিপত্যকে পর্যদুস্ত করেছে। বহুল প্রতীক্ষিত সকলের আশা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইচ্ছাতেই অন্তবর্তীকালীন সরকারের আগমন। দীর্ঘ দিনের সকলের একটাই প্রত্যাশা, তা হলোÑ রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে প্রকৃত সোনার বাংলাদেশ গড়া। ৫ আগস্টের পর ‘সংস্কার’ শব্দের সাথে মানুষ অনেক বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেছে। সংস্কার অর্থ হলোÑ মেরামত বা সংশোধন। অর্থাৎ, রাষ্ট্র কাঠামোকে সুষ্ঠু উপায়ে বিন্যাস করে সম্পূর্ণ জনগণের কল্যাণের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় ভ‚মিকা রাখা। এতে কোনো সেক্টর যাতে ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে নিয়োজিত না হতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা। একটি দেশ উন্নয়নের জন্য কতিপয় বিষয়ের সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিতেই হবে।
প্রথমত, শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন সিলেবাসকে নতুন আঙ্গিকে সাজাতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এমন বিষয় না রাখা। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষা কোর্স রাখা। আজ মানুষ বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করলেও নৈতিকভাবে দুর্বল থেকে যাচ্ছে। কাজেই ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষাকে জ্ঞানভিত্তিকের পাশাপাশি অনুশীলনমূলকের দিকেও বিশেষ নজর দেয়া উচিত। আর ছাত্র ও শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি ইত্যাদি অপসংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে দূর করা। তাছাড়া প্রয়োজনে ছাত্র সংসদ চালু করা। কোনো রাজনৈতিক দল বা তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো যাতে শিক্ষাঙ্গনে প্রভাব বিস্তার না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলেÑ প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক যে সূচকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং করা হয়, সেগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। দেশের পথশিশুদেরকেও শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য মতে, দেশে ৩৪ লাখেরও বেশি মা-বাবাহীন পথশিশু রয়েছে। ফলে অর্থের অভাব ও অভিভাবকের শাসন না থাকায় তারা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এই গোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বিগত বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে মোট ৫২ হাজার ৭৯৯ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, যা এ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তাই দেশের মেধা পাচার রোধ করে বিষয়ভিত্তিক চাকরির বাজার নিশ্চিত করতে হবে। যাতে দেশের মেধা সম্পদ দেশ গঠনে ভ‚মিকা রাখতে পারে।
দ্বিতীয়, অর্থনীতির গতিশীলতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশর অধিকাংশ জনগণ নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাদের মূল দাবিই হলো– পরিবারের সাথে খেয়ে–দেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করা। কিন্তু এর মূল অভিশাপ হিসেবে আসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, দেশের খেটে খাওয়া মানুষ সবসময়ই সরকারের সাফল্য বিবেচনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে প্রধান বিবেচনায় রাখবে। আর তা না হলে, যতই উন্নতি করুক না কেন, জনগণ সরকারকে সামর্থন করবে না। সেজন্য সরকারের প্রধান গুরুত্ব থাকতে যেভাবেই হোক সিন্ডিকেটেক ভেঙে দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা।
তৃতীয়, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা প্রদান করা। বিগত সরকার ১৫ বছরে যে ভিত্তি তৈরি করে গেছে, তা অল্প সময়ের মধ্যেই নির্মূল করা যাবে না। এখনো মানুষ নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের নিয়ে উদ্বেগ বেশি। বিগত দিনে প্রতিপক্ষ নানা রূপে বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করার চেষ্টা চালিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং তা চালিয়েও যাচ্ছে। সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো সুগঠিত করতে হবে। বিশেষ করে গত স্বৈরশাসকের সময়ে পুলিশকে জনগণের সেবক থেকে যেভাবে লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে, তা যেন পরবর্তী কোনো সরকার সে চেষ্টা করতে না পারে। এজন্য আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে। গণহত্যায় পুলিশকে ব্যবহারের মাধ্যমে যে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়েছে, তা শুধমাত্র পোশাক ও লোগো পরিবর্তন করে দূর করা সম্ভব নয়। সেজন্য তাদের নীতি–নৈতিকতা দিক উন্নতির দিকে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার।
চতুর্থত, সংবিধান যেহেতু রাষ্ট্রের প্রধান আইন, তা প্রয়োজন সাপেক্ষে পূণর্লিখন বা সংশোধন করতে হবে। দুই মেয়াদের বেশি ব্যক্তি ক্ষমতায় না থাকা। বিগত সময়ে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের মতো করে সংশোধন করেছে। এই সরকার যেহেতু সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনপুষ্ট, তাই সংবিধান তৈরিতে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করতে হবে। এতে ক্ষমতার পালাবদলেও সংবিধান দলের স্বার্থে ব্যবহৃত হবে না। তাই দেশ পরিচালনায় প্রধান নীতিনির্ধারনে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করতে হবে। আর তা না প্রকৃত সংস্কার হবে না। আর দেশ কোনো দলের নয়; বরং সকল নাগরিকের। বিগত সময়ে দেশকে বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে নিজেদের মতো করে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন– দিবস পালন, মূর্তি তৈরি, বিমানবন্দরে নামসহ নানা স্থাপনা ইত্যাদি। এতে দেশ সবসময় কোনো না কোনো ভাবে দলকেন্দ্রিক ছিল। সংসদে একক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সকলের অংশগ্রহণ থাকা। এতে শাসকদের মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাব ফুঁসে উঠবে না।
পঞ্চমত, বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। আর স্বৈরাচারীর দোসরদের সকলের এমনভাবে বিচার করা যাতে তা পরবর্তীতে সরকারের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। সবাইকে এটা ভাবতে হবে যে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আর সংবাদ প্রকাশে মিডিয়াতে হস্তক্ষেপ না করা।
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ এ প্রকাশিত ‘সংস্কারের জন্য যতক্ষণ লাগে ততক্ষণ ক্ষমতায় থাকুন’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ২,৩৬৩ জনের ওপর করা জরীপে জানা যায়, ৮১ শতাংশ চান সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার টিকে থাকুক। ফোনে নেওয়া সাক্ষাতকারে ৪৭ শতাংশ দুই বছর বা তার বেশি, ৩৫ শতাংশ এক বছর বা তার কম এবং ১৩ শতাংশ অবিলম্বে নির্বাচনের পক্ষে। অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে যতটুকুই সময় থাকুক না কেন উল্লিখিত বিষয়গুলো অবশ্যই সমাধান করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারেকে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করে এই বিষয়গুলো সমাধানে আসতে হবে এবং প্রয়োজনে দলগুলোর সংস্কার করা। তা–না হলে জনগণের আশা আকাশকুসুমই থেকে যাবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়