ইউরোপের পাহাড়ি দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সুইজারল্যান্ড। দেশটি আয়তনে ছোট হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে এর খ্যাতি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। পাহাড়, পর্বত, নদী ও হ্রদের বিচিত্র সমাহার ঘটেছে এখানে। ক্ষুদ্র পর্বতময় দেশ যার ৭০ ভাগ ঘিরে রয়েছে আল্পস পর্বতমালা। এছাড়া দেশটির রয়েছে নিরপেক্ষতার এক লম্বা ইতিহাস। বছরের পর বছর ধরে তারা কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। এমনকি বিশ্বযুদ্ধেও কোনো পক্ষ নেয়নি। এ নিরপেক্ষতাই তাদের নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। এ জন্যই রাষ্ট্রটিকে অত্যন্ত নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই ব্যাংক ব্যবস্থাও এখানে খুব নিরাপদ। গোপন অর্থ রাখার দেশ হিসেবে সুইস ব্যাংকের কুখ্যাতি বা সুখ্যাতি বিশ্বজুড়ে। আর এ জন্যই বিশ্বের ধনীদের অর্থ জমানোর জনপ্রিয় উৎস হলো এই সুইস ব্যাংক।
সুইজারল্যান্ডকে আমি প্রথম দেখি সিনেমা পর্দায়। বলিউডের ঋষি কাপুর, শ্রীদেবী এবং বিনোদ খান্না অভিনীত ত্রিকোণ প্রেমের ছবি ‘চাঁদনিতে’। ছবির মতো সুন্দর দেশটি দেখে প্রথম দর্শনেই মোহিত হয়ে পড়ি। এরপর আরও অনেকবার সিনেমার পর্দায় দেখেছি। দেশটির প্রতি মুগ্ধতা তো কমেইনি বরং বেড়েছে। অবশেষে চাকরির সুবাদে সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের সুযোগ ঘটে গেল। আমার জীবনে দেখা সেরাদেশ ভ্রমণের কথা বললে সুইজারল্যান্ডের কথাই বলতে হয়। তাইতো স্মৃতির রেশ এখনো মনজুড়ে উজ্জ্বল।
এটি বিশ্বের অন্যতম একটি ধনী দেশ। জনসংখ্যা এক কোটিরও নিচে। খাওয়া পড়ার কোনো অভাব নেই। ধনী হলেও জনসংখ্যা নিম্নগামী। শিশু জন্মের হার প্রায় শূন্যের কোঠায়। তবে বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বয়স বেড়ে যাওয়া স্রষ্টার এক অমোঘ বিধান। জীবনের অপরিহার্য সত্য হলো মৃত্যু। এই বয়সে নানারকম সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। শরীরের কাছে মানুষ বড়ই অসহায়। তাইতো প্রবীণদের অনেকেই মনে করেন শরীরটা এখন সৃষ্টি কর্তার কাছে সঁপে দেওয়াটাই যেন শ্রেয়। তাতেই হবে অনাবিল সুখ আর অমরত্ব।
যিনি নিজেই নিজের প্রাণ বিনাশ করেন, তিনি আত্মঘাতী হিসেবে সমাজে বিবেচিত। বিশ্বের অনেক দেশ আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধরূপে গণ্য করেন। আবার অনেক ধর্মে আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। তারপরও তো মানুষ আত্মহত্যা করেন, নিজের জীবন প্রদীপ নিজেই নেভান।
সুইজারল্যান্ডে কিন্তু আত্মহত্যা করা বা আত্মহত্যায় সহায়তা প্রদান করা আইনিভাবে বৈধ। জানা গেছে, দেশটিতে গত এক বছরে হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। আর আত্মহত্যা করতে সাহায্য করেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যার নাম ‘এগজিট ইন্টারন্যশনাল’। আত্মহত্যার জন্য যে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়, তার নাম ‘সারকো’। বাইরে থেকে যন্ত্রটি নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি ভেতর থেকেও তা চালু করা যায়। অর্থাৎ মৃত্যুর প্রত্যাশায় যে ব্যক্তি ওই যন্ত্রটির ভেতরে ঢুকবেন তিনি নিজেও যন্ত্রটি চালাতে পারবেন। এই সংগঠনটির যিনি প্রধান, তাকে সবাই ‘ডক্টর ডেথ’ নামে চেনে।
জীবন এক অনিশ্চিত ভ্রমণ। আর মৃত্যু অনিবার্য। একটা বয়সে প্রতিটি মানুষ চায় তার মৃত্যু যেন সহজ, সুন্দর ও বেদনাবিহীন হয়। তাইতো সুইজারল্যান্ড বাস্তবতার নিরিখে বিষয়টি বিবেচনা করেই এ বিষয়ে আইনগত বৈধতা দিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মোতাবেক প্রতিবছর প্রায় দশ লাখ লোক আত্মহত্যা করে। সুইজারল্যান্ডের মতো ধনী দেশে এত সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও আত্মহত্যার তালিকায় দেশটি প্রথমদিকে জায়গা করে নিয়েছে। জীবনের যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, গাড়ি, বাড়ি সবই যখন পেয়ে যান, তাহলে দেশটির মানুষ আত্মাহত্যার পথ কেন বেছে নিচ্ছেন?
এ পৃথিবীতে প্রকৃতপক্ষে কেউই পুরোপুরি সুখী নয়। সুখের আড়ালেই রয়েছে এক ধরনের সুখহীনতা। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা অন্তহীন। আর এই অন্তহীন আশা-আকাক্সক্ষার পেছনে ছুটে চলে সে নিরন্তর। আশা-আকাক্সক্ষার যেমন শেষ নেই, তার ছুটে চলারও যেন শেষ নেই। আশা-আকাক্সক্ষা অসীম কিন্তু পায় সে অল্প। এটাই তার চিরন্তন অতৃপ্তির কারণ। তাই সে যা পায় তাতে তার ক্ষুধা মেটে না। সে চায় আরও আরও অনেক বেশি। তাইতো মানবজীবনে পাওয়া আর না পাওয়ার দ্বন্দ্ব চিরন্তন।
সুইজারল্যান্ডে বসবাসরত অনেক বয়স্ক মানুষের ধারণা, প্রকৃত সুখ বলতে যা বুঝায় তা ওপারে, এপারে নয়। আর এজন্যই রবি ঠাকুর তার কবিতায় বলেছেন, ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’। প্রবহমান নদীর দুই পাড়ে যদিও সমান সুখ-সুবিধা ও অসুবিধা আছে, তবুও এপারের মানুষ অন্যপারের মানুষকে অধিকতর সুখী মনে করে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ক্যালভিন বলেন, মানবজীবন চিরদিন সুখশান্তিতে কাটে না। আকাশের দিকে হাত বাড়ালে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই মিলে না। তাই চাওয়া পাওয়ার গণ্ডি মাটির কাছাকাছি হওয়াই ভালো।
সারকো, কফিন আকৃতির একটি যন্ত্র। কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে মৃত্যু ডেকে আনা হয়। একবার কফিনে শুয়ে পড়লেই সব শেষ। কিভাবে কম সময়ে এই বেদনাবিহীন মৃত্যুকে আরও মসৃণভাবে কার্যকর করা যায়, এটা নিয়ে তাদের এখন গবেষণা চলছে। জানা গেছে, যারা আত্মহত্যা করতে চায় তারা বয়স্ক এবং কিছুটা হতাশাগ্রস্ত। আবার এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যারা দিব্যি সুস্থ, ঘুরছেন ফিরছেন আবার মনে মনে আত্মহত্যা করার কথাও ভাবছেন। কারণ, তার পরিবারে কেউ নেই, কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই, নেই কোনো আশা-ভরসাও। তাহলে তিনি কেন বেঁচে থাকবেন? কী নিয়ে বেঁচে থাকবেন?
তবে এই যন্ত্রটির সাহায্যে কম সময়ে বেদনাবিহীন অনায়াসে মরতে হলে ওই সংস্থায় ২০০ ডলার দিয়ে সদস্য হতে হবে। এরপর ওই সারকো নামক যন্ত্রটির ভেতর শুয়ে পড়ার আগেই তার কাছ থেকে নেওয়া হবে ৭ হাজার ডলার। আত্মহত্যা করতে হলে কোনো ক্লিনিকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সোজা নির্ধারিত ডক্টর ডেথের কাছে গেলেই হবে। এর কিছুক্ষণ পরেই জানা যাবে মৃত্যুপ্রার্থী ব্যক্তি আর নেই। কোনো এক শীতল ঘরে তিনি মারা গেছেন।
সুখ-দুঃখের সংমিশ্রণেই মানুষের জীবন। সব মানুষই সুখের পেছনে ছুটে। সুখের জন্য আমরা যতই হাঁসফাঁস করি না কেন, সুখ যেন এক সোনার হরিণ। দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। তাহলে সুখী কে? গাড়ি, বাড়ি, টাকাকড়ি, ধনদৌলত, শিক্ষা-দীক্ষা সব থাকার পরও সুইজারল্যান্ডের রাস্তা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ৭ হাজার ডলার পকেটে নিয়ে সারকো যন্ত্রটিতে আত্মহত্যা করতে যাওয়া মানুষটি, নাকি ১১৮তম সুখী বাংলাদেশের অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটি, যে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? আর এ জন্যই গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, ‘সুখ হলো মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অনুভূতি। একে ধরা যায় না, অর্জন করতে হয়’।
লেখক : চেয়ারপারসন, ব্যুরো বাংলাদেশ
সুখ নামের সোনার হরিণ
শীর্ষ সংবাদ: