ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সমুদ্র সম্পদ আহরণে কার্যকর উদ্যোগ আবশ্যক

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৯:১৮, ২৯ নভেম্বর ২০২৪

সমুদ্র সম্পদ আহরণে কার্যকর উদ্যোগ আবশ্যক

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে সরকার রাষ্ট্র মেরামতের নানা অসঙ্গতিগুলোকে চিহ্নিত করে যৌক্তিক সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রায় অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রসমূহ যথাযথ যুগোপযোগী গণমুখী করার উদ্দেশ্যে সরকারের আন্তরিকতা অবশ্যই প্রশংসনীয়। গণতান্ত্রিক-মানবিক নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মেধা ও প্রজ্ঞার সমীকরণে বৈষম্য দূরীকরণে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সমগ্র নাগরিকের সার্বিক জীবনব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন প্রকৃতপক্ষে অনিবার্য হয়ে পড়েছে। ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও অবৈধ অনৈতিক কর্মযজ্ঞে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বিগত সরকারের কদর্য পৃষ্ঠপোষকতায় স্বল্প সংখ্যক সুবিধাভোগী দুর্বৃত্তদের লুটপাট ছিল অসহনীয়। অর্থপাচার থেকে শুরু করে এহেন কোনো কাজ নেই, যাতে দেশকে প্রায় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। দেশবিধ্বংসী এসব হিংস্র নরপশুতুল্য দানবরা বিদেশে বসে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে বলে প্রবল জনশ্রুতি রয়েছে।
চলমান সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা পর্যায়ে সিন্ডিকেটের বেপরোয়া কারসাজি বাজারব্যবস্থাকে নাজুক করে তুলছে। অন্যদিকে দেশে অস্থিরতা তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন অযাচিত ইস্যুতে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিটেন্স প্রবাহে সমৃদ্ধি আর্থিক ভিত্তিকে অনেকটুকু মজবুত করলেও দুর্বৃত্তায়নের দুর্ভেদ্য প্রাচীর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা এখনো সম্ভব হয়নি। বহুমুখী সংকট মোকাবিলায় সরকারকে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তবুও বিনয়ের সঙ্গে যে বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছি তা হলো সমুদ্র সম্পদ আহরণে পর্যাপ্ত মনোযোগ। এ সম্পর্কিত কথাবার্তা বা আলাপ আলোচনায় বহু ধরনের ইতিবাচক চিন্তাচেতনা দীর্ঘসময় ধরে শোনা গেলেও বাস্তবতায় এর কতটুকু অর্জিত হয়েছে তা বোধগম্য নয়। এ সম্পর্কে দেশবাসিও সম্যক অবগত বলে মনে হয় না। জ্বালানি তেল-গ্যাস ও অন্যান্য সমুদ্র সম্পদ আহরণে পর্যাপ্ত গবেষণা পরিলক্ষিত। কিন্তু এসব গবেষণার ফলাফল প্রয়োগ নিয়ে কৌতূহল বেড়েছে।
বিশ্বের বহু দেশ সমুদ্র সম্পদ আহরণ করে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে সক্ষম হলেও; এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও অনেকাংশে পিছিয়ে আছে। জরিপ ও গবেষণা কার্যক্রমও প্রায় স্থবির-গতিহীন। দক্ষ জনবলের অভাবও প্রকট। ফলশ্রুতিতে দেশের সমুদ্র সম্পদ এখনো বহুলাংশে অনাবিষ্কৃত-অব্যবহৃত। সীমিত পর্যায়ে যে পরিমাণ তেল-গ্যাস এবং মৎস্যসম্পদ আহরণ করা তার পরিমাণ বঙ্গোপসাগরে থাকা অফুরন্ত সম্পদের তুলনায় অতি নগণ্য। বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ৪-৫ শতাংশ আসে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে। যার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৯৬০ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সমুদ্র থেকে শুধু মাছ রপ্তানি থেকেই বছরে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশের সমুদ্র বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছে মাত্র ৭ লাখ টন মাছ। দেশে বছরে যে পরিমাণ মাছ আহরণ হয়, তার মাত্র ১৫ শতাংশ আসে গভীর সমুদ্র থেকে। উপকূলীয় একালায় ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ। অর্থনীতিবিদদের দাবি, সমুদ্র অর্থনীতিকে যদি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধিত হবে। সামুদ্রিক মাছ ও শৈবাল রপ্তানি করে বাংলাদেশ বছরে বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ আয় করতে পারবে। বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমার তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে, তা টেকসই উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব হবে।
আমাদের সকলের জানা, বেলজিয়ামের অর্থনীতিবিদ গুন্টার পাওলি ১৯৯৪ সালে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির ধারণা ব্যক্ত করেন। মূলত সুনীল অর্থনীতি হলো সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি। সমুদ্র থেকে আহরণকৃত সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হলে তা সুনীল অর্থনীতি হিসেবে বিবেচ্য। সহজ কথায় সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারে সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা সুনীল অর্থনীতির মৌলিক উদ্দেশ্য। চলমান বৈশ্বিক মন্দায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশেও সুনীল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনার হাতছানি দেশবাসীকে করছে উদ্বেলিত। বিভিন্ন গবেষণায় প্রতিফলিত হয়েছে যে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে চারটি মৎস্যক্ষেত্র। সেখানে ৪৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ৭ প্রজাতির কচ্ছপ, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির তিমি, ১০ প্রজাতির ডলফিনসহ প্রায় ২০০ প্রজাতির সামুদ্রিক ঘাস রয়েছে। আরও রয়েছে ইসপিরুলিনা নামক সবচেয়ে মূল্যবান আগাছা। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও খনিজ জাতীয় সম্পদ। যেমন- তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি।
এছাড়াও রয়েছে জিরকন, রুটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিকোক্সিনসহ ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালি। যার মধ্যে মোনাজাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্র সৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুত ৪৪ লাখ টন। প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন। যা বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে। গবেষকগণ বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকায় ম্যারিন জেনেটিক রিসোর্সের অবস্থান এবং বিবিধ প্রজাতি চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলাদেশের কিছু প্রজাতির সি-উইডে প্রচুর প্রোটিন আছে যা ফিশ ফিড হিসেবে অমদানি করা ফিশ অয়েলের বিকল্প হতে পারে। আবার কিছু প্রজাতি অ্যানিমেল ফিডের মান বৃদ্ধিতে ব্যবহার হতে পারে। কসমেটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত উপাদানসদৃশ এমন সিউইডও অনেক পাওয়া গেছে।    
বিশ্ব অর্থনীতিতেও সুনীল অর্থনীতির নানামাত্রিক অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশ্বের ৪৩০ কোটিরও বেশি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। দ্য জাকার্তা পোস্টে প্রকাশ পাওয়া নিবন্ধ সূত্রমতে, দ্য লমবক ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়ন কর্মসূচিতে ৭৭ হাজার ৭০০ নতুন কর্মসংস্থান তৈরির সম্ভাবনা প্রবল। পাশাপাশি প্রতিবছর আয় করবে ১১৪ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৪ সালে তাদের মোট দেশজ উৎপাদনে সুনীল অর্থনীতির অবদান পরিমাপের চেষ্টা চালায়। ২০১৩ সালে দেশটির অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতির অবদান ছিল ৩৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তাদের মোট জিডিপির ২ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্র সম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৭ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। ২০২৫ সালে অস্ট্রেলিয়া এ খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
ইতোমধ্যে চীনের অর্থনীতিতে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামুদ্রিক শিল্প বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ চীনের জিডিপিতে সামুদ্রিক খাতের অবদান হবে ১৫ শতাংশ। এ ছাড়াও চীন, জাপান, ফিলিপিন্সসহ অনেক দেশ ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগেই সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছিল। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনটি এক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযোগী। প্রতিবেদন মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন উপকূলীয় দেশ ও দ্বীপের সরকারগুলো অর্থনীতির নতুন ফ্রন্ট হিসেবে সমুদ্র সম্পদের দিকে নজর দিতে শুরু করেছে। সমুদ্র অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে দেশের প্রবৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্র বা নীল অর্থনীতির অবদান প্রায় ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। আয়ের সর্বোচ্চ অংশ আসে পর্যটন ও বিনোদন খাত থেকে। যার পরিমাণ ২৫ শতাংশ। মৎস্য ও যাতায়াত উভয় খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ২২ শতাংশ। গ্যাস ও তেল উত্তোলন থেকে আয় ১৯ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মতে, ব্লু ইকোনমির চারটি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করলে বছরে বাংলাদেশের পক্ষে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। এই চারটি সেক্টর হলো তেল ও গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য আহরণ, বন্দর সম্প্রসারণ এবং পর্যটন। এই খাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা।
দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সমুদ্র সম্পদ আহরণের নতুন নতুন পন্থা উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি। নবতর কর্মকৌশল প্রণয়ন ও আশু-মধ্য-দীর্ঘ মেয়াদি প্রায়োগিক পদক্ষেপ দৃশ্যমান করা না গেলে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে কার্যকর প্রবৃদ্ধি অর্জন দীর্ঘায়িত হবে। ন্যূনতম অবজ্ঞা-অবহেলা পরিহার করে তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবেই। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের উন্নয়নে সচল অর্থনীতির আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষায় সমুদ্র সম্পদ আহরণের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে কালক্ষেপণ না করে এক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া সময়ের দাবি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

×