নগরায়ণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রাচীনকাল থেকেই বালুর ব্যবহার প্রচলিত। বিভিন্ন নির্মাণ কাজে বালু দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মরুভূমিতে বালু থাকলেও তা’ নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। তাই সর্বত্রই নদীর তলদেশের বালু উচ্চমানের নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যখন তখন অপরিকল্পিত উপায়ে অবাধ বালু উত্তোলন বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে উঠেছে। বালুসন্ত্রাস এবং অবৈধ বালুমহাল বাংলাদেশের জন্য ও এক নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
নদী বিধৌত বাংলাদেশের প্রায় ২৪,১৪০ কি.মি নদী রয়েছে। বহ্মপুত্র, তুরাগ, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, করতোয়া, ফেনী, তিস্তা নদীসহ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নদীতেই সংঘবদ্ধ চক্র বালুমহাল নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক হর্তা-কর্তা, এমন কী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালুমহাল ইজারার ক্ষেত্রেও মানা হচ্ছে না কোনো নীতিমালা। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, লালমনির হাট, কুড়িগ্রাম ও কুষ্টিয়া বালু উত্তোলনের প্রধান ঘাট হিসেবে চিহ্নিত।
বাংলাদেশের ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না, এছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের অবৈধ বালুমহাল টেন্ডার সন্ত্রাসকেও হার মানিয়েছে। ২০২১ সালেই অবৈধ বালু উত্তোলনের জন্য অন্তত ২৭ জনকে জরিমানা ও ৫৫ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে ড্রেজার মেশিন ধ্বংস করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মেঘনা চর দখল ও বালুমহালকে কেন্দ্র করে ১২ জন মানুষ নিহত ও প্রায় ৪৬০ জনের মতো মানুষ আহত হয়েছেন। এ ছাড়াও বালুবাহী ট্রাকচাপায় রাজশাহীতে কমপক্ষে ৪০ জন নিহত হয়েছেন।
নদীতে অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে নদী হারাচ্ছে তার নাব্য ও গতিপথ এবং নদীভাঙনের দরুন হাজার হাজার পরিবার হচ্ছেন বাস্তুচ্যুত। বালু উত্তোলন সৃষ্ট বায়ুদূষণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের মধ্যে পরিবর্তন ঘটার ফলে তাদের আবাস স্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি তাদের খাদ্যের উৎসও ধ্বংস হচ্ছে। ফলে মৎস্য প্রজনন প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়ার পাশাপাশি জমিও নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়াও নলকূপে পানি পাওয়াও কষ্টকর হচ্ছে। অবৈধ বালু উত্তোলন একই সঙ্গে পরিবেশ, সামাজিক ও বাস্তুসংস্থানজনিত সমস্যার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে অবাধ বালু উত্তোলন নদীর তলদেশ ও নদীপাড়ের কার্যক্ষতা কমিয়ে দিচ্ছে এবং নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ কমিয়ে দিচ্ছে। যখন নদীতে অতিরিক্ত বালু উত্তোলন করা হয় তখন নদীর প্রবাহ কমতে থাকে, যার কারণে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়। নদীভাঙনের দরুন অনেক মানুষ বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে বালু উত্তোলন জনিত নৈরাজ্য পরিবেশগত সংঘাতের সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্পর্কিত। অতিরিক্ত মাত্রায় বালু উত্তোলন নদীর জলপ্রবাহ কমিয়ে নদীর ক্ষয় বাড়িয়ে তুলছে। যার কারণে নদীর পাড়ভাঙা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের কারণে নদীর আশপাশের অব কাঠামো, বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, সেতু, ফসলি জমি ইত্যাদিকে হুমকির সম্মুখীন করে তুলছে। বালু উত্তোলনের কারণে নদীভাঙন ও বন্যার ফলে অনেক লোকজন বসতভিটা হারিয়ে অভ্যন্তরীণ শরণার্থী হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে।
অবাধ বালু উত্তোলন দিন দিন পরিবেশের জন্য নানাবিধ হুমকি তৈরি করছে। তাই অবৈধ বালু উত্তোলন রোধে জনগণ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, গণমাধ্যম সবার দায়িত্বশীল এবং কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত। আমাদের বর্তমান কাজের দ্বারাই ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়। তাই পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সকলের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
[email protected]
অবাধ বালু উত্তোলন নয়
শীর্ষ সংবাদ: