বাংলাদেশে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বেসরকারি ব্যবসয়িক প্রতিষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ দিয়েছে। বলা হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করাই এর মূল উদ্দেশ্য। সম্প্রতি হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপে বাংলাদেশ ব্যাংক রিসিভার নিয়োগ দেওয়ার পর বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ দেওয়া নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহল বরাবরের মতো সরকারি যে কোনো উদ্যোগের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে এবারও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু দুর্বৃত্ততাড়িত ও সর্বদা মুনাফাকামী পুঁজিবাদী বিশ^ ব্যবস্থার ঘোর অনুসারী বাংলাদেশের মূলধারার ব্যবসায়ী মহল কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করে না এবং সবকিছু বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ারই পক্ষে, সেহেতু তাদের এমন উদ্বেগ অস্বাভাবিক কিছু নয়। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত যে কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ দিয়েছে তা যথেষ্ট যৌক্তিক। বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, অর্থনীতিতে স্পর্শকাতর এ বিষয়টি যাতে সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক-রিসিভার নিয়োগের সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণের আগে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের এ সংক্রান্ত পদক্ষেপের দিকে কিছৃুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বেক্সিমকোতে নিয়োগ দেওয়া রিসিভারের কাজ হবে গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালককে ইতোমধ্যেই রিসিভার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর বেক্সিমকো গ্রুপের সব সম্পত্তি সংযুক্ত করে তা ব্যবস্থাপনায় ৬ মাসের জন্য একজন রিসিভার নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরে ১২ নভেম্বর আপিল বিভাগ বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে রিসিভার নিয়োগের আদেশ বহাল রেখে কেবল বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে রিসিভার নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে আপিল বিভাগ রিসিভার নিয়োগ নিয়ে হাইকোর্টের জারি করা রুল দুই সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তিরও নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লেখ্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাইস চেয়ারম্যান, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃৃতি সৃষ্টির অন্যতম কারিগর হিসেবে বহুলভাবে সমালোচিত এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন কারাবন্দি। বেক্সিমকো গ্রুপের অধীনে দ্য বেক্সিমকো গ্রুপ, বেক্সিমকো জুট, বেক্সিমকো ফার্মা, বেক্সিমকো সিনথেটিক্স, বেক্সিমকো টেক্সটাইল অ্যাপারেল, শাইনপুকুর সিরামিক, বেক্সিমকো পেট্রোলিয়াম, বেক্সিমকো পাওয়ার, বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং, বেক্সিমকো মেরিন ফুডস, বেক্সিমকো আইটি, আইএফআইসি ব্যাংক, ইয়েলো, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, আকাশ ডিটিএইচ, বেক্সিমকো রিয়েল এস্টেট, বেক্সিমকো কম্পিউটার, বেক্সট্রেড, বেক্সিমকো সিকিউরিটিজ, বেক্সিমকো কমিউনিকেশনস, ওয়েস্টিন হোটেল বাংলাদেশ, শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাব, বেক্সিমকো ফুডস, গিগা টেক, বেক্সিমকো ফিশারিজ, বেক্সিমকো পোর্টস, বেক্সিমকো ইঞ্জিনিয়ারিং, বেক্সিমকো পিপিই, বেক্সিমকো পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড নামে বেক্সিমকো গ্রুপের ৩০টি প্রতিষ্ঠানে ৭০ হাজারের বেশি কর্মী নিয়োজিত আছেন। এসব প্রতিষ্ঠান সালমান এফ রহমান ক্ষমতা ও ঘুষ-দুর্নীতির জোরে নামে-বেনামে প্রায় ২০টি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন একাধিক নিয়ম শিথিল করে সালমান রহমানকে দেদারছে অর্থ নিতে সহায়তা করে। সরকারি-বেসরকারি ৮টি ব্যাংকেই বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের পরিমাণ (নন-ফান্ডেডসহ) দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এসব ব্যাংক বেক্সিমকোর একাধিক বন্ডে আরও ২ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর বাইরে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও বেক্সিমকোর বিপুল ধারদেনা রয়েছে। এর আগে অত্যন্ত বিতর্কিত বহু স্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনিতে একাধিক প্রশাসক বসাবে বলে জানিয়েছে বর্তমান সরকার। এমএলএম আইন পাসের পর সম্প্রতি ওই আইন বাস্তবায়নের জন্য যে বিধিমালা তৈরি করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তার আলোকেই এই গ্রুপে এক-একাধিক প্রশাসক নিয়োগ হতে পারে। গত বছরের নভেম্বরে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড ও ট্রি প্ল্যানটেশনের নামে থাকা সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এক বছর ধরেই জমি, ফ্ল্যাট ও গাড়িসহ ডেসটিনির যাবতীয় সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও তদারকির দায়িত্ব পুলিশ পালন করছে। তবে পুরো সম্পত্তি দখলে নিতে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশের নিরীহ মানুষকে মুনাফার লোভ দেখিয়ে ডেসটিনি গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে আছে। এদিকে পোশাক শ্রমিকদের বেতন দিতে গড়িমসির ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের সমস্যা পেলে সেখানে প্রশাসক বসিয়ে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। উল্লেখ্য, গণআন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সরকার পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বকেয়া বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ ও মিরপুরের মতো পোশাক কারখানা-অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিকদের মাঝে তীব্র অসন্তোষ ও অস্থিরতা বিরাজ করছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রশাসক-রিসিভার এখন আলোচিত বিষয় হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ নতুন কিছু নয়। এ ধরনের উদ্যোগ মূলত শুরু হয় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধপরবর্তী সময়ে জাতীয়করণের মোড়কে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি ও শিল্প খাতে স্থিতিশীলতা আনতে তৎকালীন সরকার বেশ কয়েকটি বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করেছিল। একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিল্প-কারখানা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হয়েছিল। তৎকালীন সরকার বলেছিল, এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও শিল্প খাতকে ত্বরান্বিত এবং সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা হবে। তবে ১৯৭৫ সালের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয় এবং অনেক প্রতিষ্ঠানকে আবারও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় দেশে মিশ্র অর্থনীতির পথপরিক্রমা শুরু হয়, যা এখনো চলমান। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ের জাতীয়করণের এই উদ্যোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জাতীয়করণের ফলে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া গেলেও অসুবিধাও হয়েছিল। যেমন সুবিধার মধ্যে ছিল প্রথমত, জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকার আর্থিক খাত, শিল্প খাত এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, যা আর্থিক ও অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দ্বিতীয়ত, জাতীয়করণের ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাভের পরিবর্তে জনসেবার লক্ষ্যে কাজ করানোর মানসিকতা সৃষ্টি সহজ হয়, যা সরকারি পরিষেবার গুণগতমানের উন্নতিতে সহায়ক হয়েছিল। তৃতীয়ত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত মুনাফার জন্য শহরমুখী থাকে। জাতীয়করণের ফলে এসব প্রতিষ্ঠানকে সারাদেশে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিষেবা দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা গিয়েছিল। চতুর্থত, জাতীয়করণের ফলে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসনিক কার্যক্রমের ওপর নজর রেখে কর্মীদের মাঝে সততার সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের কারণে কিছু অসুবিধাও পরিলক্ষিত হয়েছিল। প্রথমত, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রথাগতভাবেই কাজের প্রতি উদাসীনতা বা দক্ষতার অভাব রয়েছে। এতে বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি খাতের সেবার গতি ও মান কমে যায়। দ্বিতীয়ত, জাতীয়করণ প্রক্রিয়ায় সরকার একটি নির্দিষ্ট খাতের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখে, যা প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেয় এবং এর ফলে বাজারের স্বাভাবিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। তৃতীয়ত, অতিরিক্ত ব্যয় ও লোকসান। সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক ক্ষেত্রে বাজেটের চেয়ে বেশি ব্যয় হয় এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রতিষ্ঠান লাভজনক না হওয়ায় সরকারের অর্থনৈতিক দায় বেড়ে যায়। চতুর্থত, রাজনৈতিক প্রভাব। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও অপচয় বেশি হয় বলে দেখা গেছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঠিকভাবে নীতি প্রয়োগ ও দক্ষ কর্মী নিয়োগে সমস্যা সৃষ্টি হয়।
অর্থনীতি শাস্ত্র ও সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে জাতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সময় বেসরকারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রয়োগের উপায়। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা, গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে পুনরুদ্ধার এবং বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা। বিভিন্ন দেশে বিশেষত যেখানে আর্থিক বা অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় সেখানে সরকার এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকার এমন খাতকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে যেগুলো জাতীয় স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ ব্যাংকিং, জ্বালানি, যোগাযোগ ও পরিবহন খাতের কথা বলা যায়। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জরুরি সম্পদের সুরক্ষা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আর্থিক সংকটে পড়ে তাহলে অনেক সময় তাদের সেবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে স্থিতিশীল রাখতে পারে। বড় প্রতিষ্ঠান বা খাতে কর্মরত অনেক কর্মী জাতীয়করণের ফলে তাদের কাজের স্থায়িত্ব পায়, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে সহায়ক। সংকটকালীন পরিবেশে মানুষের প্রয়োজনীয় সেবা যেন অব্যাহত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য জাতীয়করণ একটি কার্যকর পদক্ষেপ। অপরদিকে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে সরকার একটি প্রতিষ্ঠান বা খাতের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রশাসন পরিচালনা করে।
এটি সাধারণত সংকটময় পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান বা খাতটির স্থায়িত্ব ও কার্যক্রম নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয়। এর মাধ্যমে সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোয় কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। প্রশাসকেরা সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করায় সংকটকালে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া যায়। সংকটকালে বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয় প্রয়োজন হয় এবং প্রশাসকেরা এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুসরণ করে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারেন। অন্যদিকে রিসিভার নিয়োগ মূলত অর্থনৈতিক সংকটে পড়া বা দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কায় থাকা কোম্পানিগুলোর জন্য করা হয়। রিসিভার কোম্পানিটির সম্পদ ও দায় পরিচালনার জন্য দায়ী হন এবং সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য করণীয় পদক্ষেপ নেন। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকটে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে দেউলিয়া না হয় এবং তাদের সম্পদ বিক্রি না করতে হয় সেজন্য রিসিভার কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। রিসিভার নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির ঋণদাতাদের স্বার্থরক্ষা করা এবং প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ ও দায়-দায়িত্বের সঙ্গে পরিচালনাও সহজ হয়। রিসিভার তার অধীন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন পুনর্গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সাধারণভাবে বলা যায়, জাতীয়করণ, প্রশাসক বা রিসিভার নিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতি ও প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সংকটের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। এতে কর্মীদের চাকরি সুরক্ষিত হয় এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ আনার মাধ্যমে জনসেবা অব্যাহত রাখাও সহজতর হয়। তবে সঠিক নীতি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে জাতীয়করণ, প্রশাসক ও রিসিভার নিয়োগ এবং কার্যক্রম পরিচালিত না হলে এই উদ্যোগ হিতে বিপরীতও হতে পারে। এর কারণ সরকারের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো দক্ষতা বজায় রাখা কঠিন হয়। সরকারের নিয়োগ করা প্রশাসক বা রিসিভাররা রাজনৈতিক প্রভাবিত হয়ে সরকারি নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠানে প্রতিফলিত হতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করে। প্রশাসকরা সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং তাদের লক্ষ্য থাকে স্বল্পমেয়াদি ফলাফলের দিকে। ফলে প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া নিয়মিত প্রশাসক পরিবর্তনের ফলে প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের স্থায়িত্ব থাকে না, যা কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি এবং কাজের পরিবেশ নষ্ট করতে পারে।
জাতীয় বা অর্থনৈতিক সংকটের সময় জাতীয়করণ, প্রশাসক বা রিসিভার নিয়োগ আর্থিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর উপায় হতে পারে। কিন্তু এটি অর্থনীতির ওপর অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও ফেলে। অন্তর্বর্তী সরকারের এখন পর্যন্ত নেওয়া এ সংক্রান্ত উদ্যোগগুলো যথেষ্ট যৌক্তিক হলেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেসরকারি খাত যেন বাধার মুখে না পড়ে এবং ভিন্ন কোনো বার্তা না যায় সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা, সততা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই উদ্যোগগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সংকটে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
প্রশাসক-রিসিভার নিয়োগ ॥ একটি পর্যবেক্ষণ
শীর্ষ সংবাদ: