ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কার্যক্রম

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ১৯:৩৩, ২৭ নভেম্বর ২০২৪

অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কার্যক্রম

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণস্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণস্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। চলতি বছরে জুন শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। যা একই সময়ের মোট ঋণ স্থিতির ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩Ñএই ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ছোট-বড় ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেওয়া এ অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠরা দেশের ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর সহায়তায় সরকারঘনিষ্ঠরা প্রথমে ব্যাংক দখল ও পরে এই অর্থ পাচার করেছে বলে দাবি করেন তিনি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই তথ্য জানিয়েছেন।
অর্থনীতি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সব সূচকের অবনতিই তার সাক্ষ্য। মূল্যস্ফীতি হারের সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধি মিলছে না। দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে দারিদ্র্যসীমার নিচের পরিবার শুধু নয়, নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষও পর্যুদস্ত। বৈষম্যের অভিঘাতে মানুষ জর্জরিত। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত অংশের সঞ্চয়, আয় ও কর্মসংস্থানে বড় ধরনের আঘাত পড়েছে। এসবের প্রভাব যুবকদের জনশক্তিতে রূপান্তর না করে অনিশ্চিত যাত্রায় ঠেলে দিচ্ছে। সমাজের মাঝখানের শ্রেণিগুলোতে ভাঙন ধরেছে। একইভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোও মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে আক্রান্ত। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও তার সুফল কৃষক পান না, পান মধ্যস্বত্বভোগীরা। কৃষকের দিন আনি দিন খাই বা ঋণ করেই যাপিত জীবন চলছে। ঘরে ঘরে নগদ টাকায় টান পড়েছে। ঋণে জর্জরিত সরকারেরও অর্থাভাব প্রকট। আয় কম বলে পাওনা পরিশোধে হিমশিম অবস্থা। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ও সরবরাহ কমে আসায় ডলারের বিপরীতে টাকার টানা পতন অর্থনীতিতে গভীর নিম্নচাপের জন্ম দিয়েছে। আইএমএফের বেলআউট প্যাকেজের আওতায় অর্থনীতি শুশ্রƒষায় আছে।
এখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ‘উন্নয়ন-বিস্ময়’ নিয়ে নীরব; বরং বিশ্বের বিভিন্ন ঋণমান পূর্বাভাসকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ঋণমান নামিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যমান হাত-ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব-কেন্দ্রীভূত হওয়ায় বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’ কাজ করতে পারছে না। নাগরিকেরা এই দুর্বিষহ জীবন থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছেন। একই প্রেক্ষাপটে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে অস্থিরতা চলমান। ভূরাজনৈতিক ছায়াযুদ্ধের হুমকিও বিদ্যমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ম্যান্ডেট বা দায়িত্ব মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এ লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রা সরবরাহ, বৈদেশিক লেনদেন বিনিময়, সুদের হার নির্ধারণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহকে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মানানসই না করে বড় অঙ্কের অর্থ ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে। এই ছাপানো টাকা আবার মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে। টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে টাকা ধার করায় সুদহার বেড়ে হয়েছে ১১ শতাংশ। সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি রোধ নিয়ে সন্দেহ আছে। সুদহার বৃদ্ধিতে উৎপাদন খাত ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিলে দেশের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। ঋণ পরিশোধ করতে টাকার দরকার হবে। তখন মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। দ্বিতীয়ত, সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে প্রথমবারর মতো ঘাটতি বেড়ে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। পুঁজি পাচার, হাওলা ও হুন্ডিসংক্রান্ত অভিযোগ নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপও নিতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা লাগামহীন।
মূল্যস্ফীতির চাপ লাঘবে অর্থ মন্ত্রণালয় তথা রাজস্বনীতির বড় ভূমিকা থাকে। মানুষ দুর্দশায় নিমজ্জিত হলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় জীবনযাপন চালিয়ে নেওয়ার বিধান সারা পৃথিবীতেই আছে। কিন্তু সামাজিক সুরক্ষা জাল ছিন্নভিন্ন, বিক্ষিপ্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বেড়েছে। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় সরকারি অর্থ ব্যয় হলেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলের কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ। অযৌক্তিক প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোয় ঋণের পরিমাণও বেশ বেড়েছে। অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়েনি। বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার হার গত ১৪ বছরে বেড়েছে ৩২২ শতাংশ। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাওনার পাহাড় জমছে। ভর্তুকি ও প্রণোদনা পরিশোধের মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। কর ও মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অনুপাতের দিক দিয়ে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান একেবারে তলানির দিকে। জিডিপি যা দেখানো হয়, সে অনুযায়ী বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এমনটা হওয়ার কথা নয়। সঞ্চয় হার কমে যাওয়ায় স্থবির হয়ে থাকা বিনিয়োগ আরও কমছে। আনুষ্ঠানিক খাতে নতুন কর্মসংস্থান না বাড়ায় অনানুষ্ঠানিক খাতে সৃষ্ট কর্মসংস্থান কখনই টেকসই হতে পারে না; বাইরের অভিঘাত মোকাবিলা করতে পারে না।
ইতোমধ্যে দুই জেনারেশন সর্বজনীন ও গুণগত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিশিল্পায়ন ঠেকানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির কৌশল অনুপস্থিত। বর্তমানের ভোগ ব্যয়কেন্দ্রিক জিডিপি বৃদ্ধির মডেল থেকে বেরিয়ে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগকেন্দ্রিক টেকসই সবুজ প্রবৃদ্ধির কাক্সিক্ষত অগ্রযাত্রা অধরাই থেকে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা টানতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন বা পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারকে। বড় অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশ যে ঋণ নিচ্ছে তার পরিমাণ মাত্র সাত বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন যে ঋণ করছে, তার একটি বড় অংশও যাচ্ছে সেই ঋণ পরিশোধের পেছনেই।
আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট সহায়তার জন্য বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণ নেয় শেখ হাসিনার সরকার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকেই সবচে বেশি ঋণ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে ২০১৭ সালের শেষে বাংলাদেশের সার্বিক মোট ঋণ ছিল ৫১.১৪ বিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এটি ১০০.৬৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর সুদ এবং আসল পরিশোধের পরিমাণ প্রতিবছর বাড়ছে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক, রাজস্ব আহরণ, রপ্তানি বাণিজ্য, ডলার সংকট ও রিজার্ভ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেনÑ ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়তে পারে। একশ’ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণটা এর মধ্যে বেশিরভাগই সরকারের ঋণ। ঊনাশি বিলিয়ন ডলার তো সরকারের। সেটা জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে সতেরো শতাংশের কাছাকাছি। খুব একটা চাপ না। কিন্তু পরিশোধ করার পরিমাণটা সুদ এবং আসল মিলিয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশ কার কাছে কতটা ঋণে রয়েছে সেই বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ডাটা পাওয়া যায়। এ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণ ছিল ৫৫.৬০ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণের অর্ধেকের বেশি ৫৭ ভাগ হলো বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছে। আর দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে ঋণ করেছে তার মধ্যে জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারত এই চারটি দেশই প্রধান। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বেলায় বাংলাদেশ জাপানের কাছেই সবচে বেশি দেনায়। জাপানের কাছে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ ৯.২১ বিলিয়ন ডলার। এরপরই রাশিয়ার কাছে ৫.০৯ বিলিয়ন, চীনের কাছে ৪.৭৬ বিলিয়ন এবং ভারতের কাছে ১.০২ বিলিয়ন ডলার ঋণী বাংলাদেশ।
বর্তমানে এ ঋণ আরো অনেক বেশি। কারণ ইআরডির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫শ’ ৬৩ কোটি ডলার ঋণ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এডিবি থেকে ১৪০ কোটি এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ৯৬ কোটি ডলার নিয়েছে বাংলাদেশ। একই সময়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান থেকে ১৩৫ কোটি, রাশিয়া থেকে ৮০ কোটি, চীন থেকে ৩৬ কোটি, ভারত থেকে ১৯ কোটি এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির প্রবণতায় দেখা যায়, সরকারের বৈদেশিক ঋণ এবং এর পরিশোধ দুটোই ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের যে ঋণ ৫০ বিলিয়ন ছিল সেটি ২২-২৩ অর্থবছরে ৬২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। এই ঋণ পরিশোধের ধারাও ঊর্ধ্বমুখী। পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে চলেছে। চলমান অর্থবছরের জন্য তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বরাদ্দ রাখতে হয়েছে বাজেটে। আগামী বছরগুলোতে সেটি চার বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। উল্টো বিদেশে অর্থ পাচার, উচ্চশিক্ষা ও বিদেশে চিকিৎসার জন্য বিলিয়ন ডলারের বাড়তি ব্যয় হচ্ছে, যেটা দুশ্চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশে বাস্তবতা হলো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে একটা বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা রয়েছে সরকারের কাঁধে। ডলারের রিজার্ভও ক্রমাগত কমছে। সেই সঙ্গে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যয় আরো বেড়েছে টাকার অঙ্কে। টাকার অঙ্কে কিন্তু বৈদেশিক ঋণ প্রায় চল্লিশ শতাংশ বেড়ে গেছে। বিরাশি থেকে ১১৭ হয়ে গেছে অর্থাৎ আমাদের রাজস্ব চল্লিশ শতাংশ বেশি কালেক্ট করতে হবে। এটা বড় সমস্যা। আমাদের ম্যাক্রো (সামস্টিক অর্থনীতি) স্ট্যাবিলিটি ধরে রাখা কঠিন হবে। সেইসঙ্গে রাজস্ব বাড়াতেই হবে। তা না হলে ম্যাক্রো স্ট্যাবিলিটি বজায় রাখা যাবে না। যেসব সেক্টরে কাঠামোগত দুর্বলতা আছে সেখানে বিনিয়োগ করে বৈদেশিক মুদ্রা সেভ করতে হবে।
বিদেশী ঋণের সমস্ত দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের কাঁধেই পড়বে। জনগণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায় করেই সরকারের আয় বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) গত ডিসেম্বরের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণদানে শীর্ষ দেশ ও সংস্থার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান, এডিবি ও চীন। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বিদেশী অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল গত সরকার। এর মধ্যে ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ। কোনো কোনো প্রকল্পের ঋণের শর্ত ও এর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিদেশী ঋণ ও ঋণ শোধের চাপ বাড়লেও রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও বিদেশী বিনিয়োগ সেভাবে বাড়ছে না। আট বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৩৫ শতাংশ (২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে)। কিন্তু রপ্তানি আয় ৬২, প্রবাসী আয় ৬০ ও বিদেশী বিনিয়োগ ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এই তিন খাতে আয় ঋণের অনুপাতে না বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমেছে। বর্তমানে দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকলেও বড় ঘাটতি রয়েছে আর্থিক হিসাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৫২৩ কোটি ডলার। আর জানুয়ারি শেষে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩৫ কোটি ডলারে। এই ঘাটতির একটি কারণ বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়া। এখন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালন সরকারকেই সেই ঋণের চাপ বহন করতে হবে। সবমিলিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়ে গেছে, যার দায় বহন করছে বর্তমান সরকার। তবে বর্তমান সরকার দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

×