জোরপূর্বক বা হুমকির জেরে অন্যের অর্থ বা সম্পদ আত্মসাৎ করাই যেন বর্তমান যুগের এক গোষ্ঠীর দৈন্দিনের জীবনের রুজি-রুটির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সমাজে এমন কোন মানুষ নেই, যিনি চাঁদাবাজি সম্পর্কে অনবগত। কেননা প্রতিটি মানুষই কোন না কোনভাবে চাঁদাবাজির স্বীকার হয়েছেন আবার কাউকে জীবন দিয়েও গুনতে হয়েছে এর মাশুল। যতদিন যাচ্ছে চাঁদাবাজি হয়ে উঠছে সাধারণ জনগণের নিকট এক আতঙ্কের নাম। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই হারাতে হচ্ছে পণ্য, সম্পদ, বাহন, পরিবহন চালানোর অনুমতি, মালিকানাধীন সম্পদ ও পারিবারিক নিরাপত্তা। আবার কারো কারোর বলির পাত্র হচ্ছে স্বীয় জীবনই। এ চাঁদাবাজি যেন ক্রমশে গ্রাস করছে প্রতিটি অর্থনৈতিক সেক্টরকে। যার ফলে প্রতিনিয়ত উর্ধ্বগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে পণ্যের মূল্য যা জনগণের জন্য দুর্ভোগের কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। কেননা অর্থনৈতিক বিভাগ গুলোই চাঁদা সংগ্রহের একমাত্র পন্থা যেখানে চাঁদাবাজি নামক সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর ফলে সম্পূর্ণ প্রভাব পুরো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর পড়ে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কারণে দাম বেড়ে যায়।’ তাছাড়া গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, প্রতি রাতে কারওয়ান বাজারে প্রায় ৫০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়, সেখানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে স্বাভাবিক।
দীর্ঘ পনেরো বছর আওয়ামী সরকারের আমলে চাঁদাবাজির এ নৃশংস অবিচার জনগণ মেনে নিতে বাধ্য হলেও ৫ই আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী আমলের সমাপ্তি ঘটে যা কিনা জনসাধারণের নিকট এক স্বস্তির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু ভুক্তভোগীদের এই স্বস্তি কিছুদিনের জন্য বিরাজমান হলেও পরবর্তীতে চাঁদাবাজির এ ধারা। কিছু সময়ের মধ্যে আবারও পূর্বের চিত্র ধারণ করে। এ সময় জনশুনানিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাজনীতির বদল করলাম না, শুধু রাজা বদল করলাম, এটা হতে পারে না। যারা আত্মত্যাগ করেছে তাদের চিন্তা ছিল রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে, সেটা হলে আমরা এক অত্যাচারীর বদলে নতুন অত্যাচারীর আবির্ভাব দেখতে চাই না।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিসও এ বিষয়ে বলেন, ‘একটা জিনিস মনে রাখবেন আমরা নির্যাতকের পরিবর্তন চাই না, আমরা এই নির্যাতনের যে সিস্টেম তার পরিবর্তন চাই।’
অন্তবর্তী কালীন সরকারের আমলে, চাঁদাবাজির অবয়বের পরিবর্তন ঘটলেও রুপরেখার বদল ঘটেনি বরং তা আরো নতুন মাত্রায় সংযোজিত হয়েছে। বর্তমানে নতুন মাত্রায় যা সংযোজিত হয়েছে তা হলো- পরিবহন খাত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য খাত, নবনির্মিত ভবন, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও ভ‚মি দখল সংক্রান্ত কর্মকান্ড থেকে পূর্বের চেয়ে অধিক পরিমাণে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। যা পনেরো বছর শোষণের ফলে যারা চাঁদাবাজির স্বাদে অভুক্ত রয়েছে বর্তমানে তারাই শোষণের মাত্রা কে তীব্র থেকে তীব্র করে তুলছে এই কথারই বর্ণনা দেয়। আর এ শোষণ যুগ যুগ ধরে পরিচালিত হচ্ছে উচ্চস্তরের রাজনৈতিক কর্মকর্তা কর্তৃক নি¤œস্তরের অসহায় দরিদ্র পর্যন্ত।যেখানে মন্ত্রীসভা থেকে শুরু করে এলাকার পাতি নেতাদেরও ভ‚মিকা বিদ্যমান।
রাজধানীর পরিবহন খাতের কথা তুলে ধরলে দেখা যায়, ট্রাক, বাস, পিকআপ, মিনিবাস, ভ্যান, লরি, ট্যাম্পু, লেগুনা ও রিক্সা সকল ধরনের পরিবহনকে প্রতিনিয়তই দিতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণে চাঁদা। আর এই চাঁদাবাজি চলে ধাপে ধাপে। পরিবহনের মালিক ও শ্রমিক থেকে চাঁদাবাজি, স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি ও মহাসড়ক পর্যন্ত এ চাঁদাবাজি চলমান থাকে। এছাড়াও মালবাহী প্রতিটি ট্রাককে রাজধানীতে প্রবেশ ও নির্গমনের জন্য দিতে হচ্ছে একটি বরাদ্দকৃত অর্থের অংশ।
ব্যবসা ও বাণিজ্যিক খাতেও চাঁদাবাজি এক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঁচাবাজার ও মাছবাজারও চাঁদাবাজির বাহিরে নয়। এমনকি ফুটপাতে দোকান খোলার পূর্বেই পরিশোধ করতে হয় চাঁদার দাবি অন্যথায় বাজারদর বন্ধ হয়ে যায়। এ চাঁদাবাজি যেনো মহামারী আকার ধারণ করেছে যা ৫ ই আগস্টের পর আরো বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। মালিকানাধীন দোকানেগুলোতেও চওড়া মূল্যে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে।
নির্মাণ ও প্রকৌশলী খাতে চাঁদাবাজি এক প্রতিদিনের চিত্র। বাড়ি নির্মাণের সময় অধিকাংশ মানুষই এ জাতীয় সমস্যার সম্মুখীন হন। স্থানীয় প্রভাবশালী দল নির্মাণের কাজে বাধা প্রদান করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন। এ পর্যায়ে যার জমির মূল্য যত অধিক তাকে তার জমির মূল্যের অর্ধেক মূল্য চাঁদা দিতে হয়। এসব খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ চাঁদাবাজির স্বীকার হয় রাজধানীর কেরানিগঞ্জ এলাকার সাধারণ জনগণ। যা পরিচালনা করে ভ‚মি দস্যু নামে এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল।
কেরানিগঞ্জ ভ‚মি দস্যুরা চাঁদাবাজি করে এক অভিনব কায়দায়। জোরপূর্বক জমি দখল করে জমির প্রকৃত মালিককে চাঁদা দিতে বাধ্য করে।জমির মালিক চাঁদা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে এবং তা বিক্রয়ের প্রচেষ্টা চালালে সেখানেও স্থানীয় প্রভাবশালীরা কমিশন দাবি করে। এবং কেরানিগঞ্জে সকল নির্মাণ কাজেও তাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং সর্বশেষ তারা অবৈধ দলিল ও নথিপত্র তৈরি করে। এভাবেই তারা ভুক্তভোগীদের নিঃস্ব করার এবং অধিক সম্পদ হরণের নেশায় মেতে উঠেছে।
চাঁদাবাজির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি, আইনশৃঙ্খল পরিস্থিতির অবনতি, সামাজিক অস্থিরতা ও মানুষের জীবনযাত্রার মানের অবনতি দিনদিন বেড়েই চলছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘দেশে চাঁদাবাজি বেড়ে গেছে। এটাকে কঠোর হাতে দমন করা হবে। দেশে বাড়তে থাকা চাঁদাবাজি দমনে কঠোর হতে হবে। অপরাধী যেই হোক না কেন, কেউই ছাড় পাবে না।’ এ অরাজকতা রুখে দিতে হলে অবৈধ সংগঠন এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কার্যকর আইন প্রণয়ন করতে হবে। এবং এর পাশাপাশি জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ