নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস
জুলাই অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র জনতার ম্যান্ডেটেই মূলত জনআকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে এ সরকারকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার। তাই এই সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের রেখে যাওয়া বিধ্বস্ত রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার, ভঙ্গুর ব্যাংক ও অর্থব্যবস্থার পুনরুদ্ধার, প্রশাসন, পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন সংস্কার, বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো গুরুদায়িত্ব সম্পন্ন করা।
যেহেতু রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন সংস্থাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে গেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার তাই রাষ্ট্রকে কার্যকর করা এবং একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করার লক্ষ্য নিয়েই পথ চলা শুরু করতে হয়েছে এই সরকারকে। প্রধান উপদেষ্টা ড, মুহাম্মদ ইউনূস ইতোপূর্বে তাঁর একাধিক বক্তব্যে বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করা হবে।’ আশার কথা হচ্ছে, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করায় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজ এক ধাপ এগিয়ে গেল।
রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ১০টি কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং ঐসব কমিশন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ শুরু করছে। জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলনে রাষ্ট্র কাঠামো, পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, ব্যাংক, বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার, অর্থ খাত, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতের সংস্কার, স্বাভাবিক সময় এসব সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা সহজ হলেও একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পর কাজটি অত সহজ নয়।
কাজেই স্বাভাবিক অবস্থায় যে কোনো সরকারের প্রথম ১০০ দিনকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, ঠিক সেভাবে দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ১০০ দিনের কর্মকা-ের মূল্যায়ন একই রকমের হবে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট বিশেষ সরকারের মূল্যায়নও হতে হবে বিশেষ দৃষ্টিতে। তবে এ মুহূর্তে সর্বাগ্রে সরকারকে অধিক মাত্রায় মনোযোগ দেওয়া দরকার মুদ্রাস্ফীতি, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরার প্রতি।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে ১৫ নভেম্বর। সময়ের হিসেবে এটি যথেষ্ট নয়। জাতি, রাষ্ট্র ও মানুষের জন্য স্বল্প সময়ের হিসাব করে অগ্রাধিকারমূলক কাজকে বিবেচনায় আনা এবং তা বাস্তবায়ন অত্যন্ত দুরূহ। তবুও এই স্বল্প সময়ে সরকারের গৃহীত কর্মসূচির বাস্তবভিত্তিক নির্মোহ মূল্যায়ন দরকার। কিন্তু এই ১০০ দিনে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার দাবি পূরণ, বা দাবি বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগ দিতে হয়েছে।
সব চেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এই প্রথম দাবি আদায়কে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক আনসার বাহিনীর সদস্য প্রশাসনের কেন্দ্র বিন্দু সচিবালয়ে জোরপূর্বক প্রবেশ করে এখানে কর্মরত সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারী, উপদেষ্টাদের এক প্রকার জিম্মি করে, লাঠি সোটা, অস্ত্র নিয়ে নৈরাজ্য চালায়। তাদের এই নৈরাজ্য চলে দুপুর থেকে টানা রাত ১১টা অব্দি। একইভাবে অটোপাশের দাবিতে বিপুল সংখ্যক এইচএসসি পরীক্ষার্থী সচিবালয়ে অনুপ্রবেশ করে অবরুদ্ধ করে সচিবালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারী ও উপদেষ্টাদের। এক পর্যায়ে তাদের দাবি আদায় করে নিতে সরকারকে বাধ্য করে।
বিগত সময়ে দেশে এ ধরনের আন্দোলন প্রত্যক্ষ হয়নি। গত ১০০ দিনের বেশিরভাগ সময়ে তথাকথিত আন্দোলনকারীদের সামলাতে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে সরকারকে। এমনও দেখা গেছে রাজধানীর সড়ক জুড়ে আন্দোলনকারিদের অবস্থান, অবরোধ হয়েছে। বর্তমান সরকারের এই ১০০ দিনে যে হারে বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থার উদ্যোগে আন্দোলন, অবরোধ হয়েছে মনের হয় বিগত ৫৩ বছরের সব দাবি-দাওয়া রাতারাতি এই সরকার বাস্তবায়ন করে দেবে। এর নেপথ্যে কোনো মহলের ইন্ধন আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার এই সরকারের।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় প্রধান প্রধান সাফল্য এবং কাজের অগ্রগতি তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এ বিষয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি সরকারের ১০০ দিনের সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি কী কী কাজ করা হচ্ছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। একটি প্রবল গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সমাজকে সঙ্গে নিয়ে আগস্টের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এ সময় পুলিশ কার্যত অনুপস্থিত ছিল। তারপরও সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সফল হয়েছে।
জুলাই-আগস্ট হত্যাকা-ের জন্য জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সরকার বহুমুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের গণহত্যার তদন্তে জাতিসংঘ-নেতৃত্বাধীন একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (তথ্য অনুসন্ধান) মিশনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবে। মিশন আগামী মাসের শুরুতে প্রথম প্রতিবেদন জমা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া দেশে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) এই হত্যাকা-ের তদন্ত করছে। হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এই বিচারকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা, যাতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এর রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে সে জন্য সতর্কতার সঙ্গে এগুচ্ছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার শহীদ পরিবারের জন্য ৩০ লাখ টাকা অনুদান ঘোষণা করেছে, আহতদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করেছে এবং শহীদ পরিবারের সহায়তায় একটি তহবিল গঠন করে শহীদ ও আহতদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া শুরু করেছে। বিগত সরকারের রেখে যাওয়া বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির কার্যক্রম চলছে। রিজার্ভে হাত না দিয়েই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক পেমেন্ট বাধ্যবাধকতা পূরণ করা হয়েছে। রপ্তানি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেপ্টেম্বরে চালান ৭ শতাংশ এবং অক্টোবরে ২০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল হয়েছে। দেশের সেরা অর্থনীতিবিদদের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে নিযুক্ত করা হয়েছে এবং তারা প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।
অন্যদিকে, এ পর্যন্ত দশটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দেবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে ঐকমত্য তৈরি করা হবে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে। সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। নতুন ও গ্রহণযোগ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনারদের খুঁজে বের করতে একটি অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের পর এটি ভোটার তালিকা প্রস্তুতির কাজ শুরু করবে।
অধ্যাপক ইউনুস অন্তর্বর্তী সরকার এবং তার সংস্কার উদ্যোগের জন্য প্রায় সব দেশ থেকে নজিরবিহীন সমর্থন পেয়েছেন। নিউইয়র্ক ও বাকুতে অনুষ্ঠিত বছরের বৃহত্তম বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোতে তাকে একজন রকস্টারের মতো সম্মানিত করা হয়েছে। বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সংস্থা আট বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলা ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সরকার লক্ষ্য পূরণে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সমাজকে সঙ্গে নিয়ে আগস্টের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এ সময় পুলিশ কার্যত অনুপস্থিত ছিল। এ সময় সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সফল হয়েছে।
ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসপূর্তিতে সম্প্রতি নিজেদের বিভিন্ন কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে মোটাদাগে পাঁচটি ক্ষেত্রে নিজেদের অর্জনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো-১০০ দিনের মাথায় দেখা যাচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসা শুরু হওয়া। রিজার্ভে হাত না দিয়েই বিলিয়ন ডলারের পেমেন্ট পরিশোধ করা। রপ্তানি খাতেও সুবাতাস বইছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০ অক্টোবর শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় হয়। একইসঙ্গে ব্যাংকিং খাতও অনেকটা স্থিতিশীল হওয়ার পথে। অর্থনীতিকে পুনরায় গতিশীল করতে দেশের সেরা অর্থনীতিবিদদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং তারা নিঃসন্দেহে অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছে।
সরকার মনে করে যে, ক্ষমতায় বসার প্রথম তিন মাসে তারা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। একইভাবে, দেশের ভঙ্গুর অবস্থা থেকে অর্থনীতি বেশ খানিকটা ইতিবাচক অবস্থানে আনতে সক্ষম হয়েছে। এর বাইরে, সংস্কার কাজ পরিচালনায় ব্যাপকভাবে বিদেশী আর্থিক সহায়তা পাওয়া, সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণা এবং বন্যা মোকাবিলার পাশাপাশি তৈরি পোশাকশিল্পের সংকট ও অস্থিরতা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়া উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, ‘এত কম সময়ের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব না। সরকার চেষ্টা করছে এবং ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেটার ফল দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।’ প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তী সরকার জনআকাক্সক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, মুদ্রা স্ফীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি সফলতা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম