ব্যবসায় শিক্ষা বা বাণিজ্য বিভাগে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি কম
২০০০ সাল বা তার পূর্বে গ্রামে ব্যবসায় শিক্ষা বা বাণিজ্য বিভাগে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি কম ছিল। এমনকি অনেক স্কুলে বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষকও ছিল না। যেমন আমি যে স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছি ঐ স্কুলে কোনো বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক ছিল না। শুধু বিজ্ঞান ও মানবিক শাখায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতো। ২০০০ সালের পর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বাণিজ্য বা ব্যবসায় শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক বেড়ে যায়। যা প্রায় টানা দুই দশক ধরে চলমান ছিল। এমনকি বিবিএ এবং এমবিএতে পড়াশোনার জন্য এক ধরনের যুদ্ধ চলত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে।
তবে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হয়। এখন শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ বিজ্ঞান এবং মানবিক শিক্ষায় ভর্তি হতে চান। এসএসসি এবং এইচএসসিতেও কমছে ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীর সংখ্যা। গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার গ্রুপভিত্তিক এমন চিত্রই পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের মতো সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে এখন ব্যবসায় শিক্ষা শিক্ষার্থীদের একচেটিয়া প্রাধান্য নেই। তাই এ শাখায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। বরং যেসব প্রতিষ্ঠানে ব্যবসায় শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের চাকরি পাওয়ার কথা, সেগুলোতে চাকরি করছেন অন্য শাখার শিক্ষার্থীরা।
এই বিষয়টিকেই বাণিজ্য শাখায় শিক্ষার্থী কমার মূল কারণ মনে করেন অনেকে। যেমন, ইতিহাস বা বাংলায় পড়াশোনা করে অনেকে ব্যাংকে চাকরি করছেন। এতে চাকরির বিভিন্ন ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরির পাশাপাশি বিষয়টি শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানলব্ধ জ্ঞান ও কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে বেমানান। শিক্ষার্থীদের যার যার পড়াশোনার বিষয় অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার ব্যবস্থা থাকলে এসব সমস্যা সৃষ্টি হতো না।
গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালে প্রতিবছরই এসএসসি পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগের পরীক্ষার্থী ছিল ৩ লাখের ওপরে। আর ২০১৮ সালে সে সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা নেমে আসে ৩ লাখের নিচে। অন্যদিকে, এইচএসসিতে ২০১৮ থেকে ২০২১ প্রতিবছরই ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখের বেশি। তবে ২০২২ সালে সে সংখ্যা ২ লাখের নিচে নেমে আসে। ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিতে রেজিস্ট্রেশন করে ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ২৭৫ শিক্ষার্থী, যেখানে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ২ লাখ ৮০ হাজার ৮১৬ জন।
অন্যদিকে, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষার্থী ছিল ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৪ জন। আর মানবিক ছিল ৮ লাখ ২৩ হাজার ৮৮৫ জন। অর্থাৎ, মোট সংখ্যার ১৭ শতাংশ ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পরীক্ষার্থী। ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬৫৭ জন। এর মধ্যে বাণিজ্যে ৩ লাখ ১৪৭ জন। বিজ্ঞানের ৫ লাখ ৭ হাজার ২৫৪ এবং মানবিক শাখার পরীক্ষার্থী ছিল ৭ লাখ ৮১ হাজার ২৫৬ জন।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগের সঙ্গে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ চালুর পর মানবিকের চেয়ে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পরীক্ষার্থীর হার বাড়তে থাকে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত পরিস্থিতি তেমনই ছিল। তবে এরপর থেকে বিজ্ঞানের পাশাপাশি মানবিকের শিক্ষার্থী বছর বছর বাড়লেও কমতে থাকে ব্যবসায় শিক্ষায়। কয়েক বছর আগেও প্রচার ছিল বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। আর এখন কমছে ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থী। চাকরিক্ষেত্রে সুযোগসুবিধা কমে যাওয়া বা কোর্স কারিকুলাম বিশ্বায়নের সঙ্গে সংগতি না রেখে পাঠদান করানো এর কারণ হতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার চাহিদার ওপর শিক্ষা নির্ভর করে। যার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীরা তাদের মাধ্যমিকসহ যেকোনো লেভেলে বিষয় পছন্দ করে থাকেন। আমাদের দেশের যে পরিমাণ বাণিজ্য শাখার গ্র্যাজুয়েট প্রয়োজন ছিল, এক সময় তার চেয়ে বেশি ছিল। যা চাকরির বাজারে শিক্ষার্থীদের বেকারের সংখ্যা বেড়ে যায়। অর্থাৎ আজকের অবস্থার জন্য এটা একটা কারণ হতে পারে। তাই হয়তো বর্তমানে মানবিক এবং বিজ্ঞানের প্রতি বেশি ঝুঁকছেন শিক্ষার্থীরা।
নতুন ধরনে বা চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কোর্স ডিজাইন করার সময় এসেছে, যা ব্যবসায় শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক তৈরি করতে পারে। এখন বিশ্বব্যাপী করপোরেট জবে, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা বিষয় দেখা হয়। যা আমাদের মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক লেভেলের কোর্স কারিকুলামে অনুপস্থিত বলা যায়। তাই কমার্সে পড়াশোনা করে চাকরির প্রতিযোগিতায় ঠিকতে পারে না। আমরা উচ্চশিক্ষার হার বাড়িয়েছি। অথচ ভারত বা শ্রীলংকা থেকে আমাদের দেশে নানা ক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে। অর্থাৎ সফট স্কিলসম্পন্ন লোকের সংখ্যা কম।
তাই শিল্প প্রতিষ্ঠান দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে ভুগছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের সফট স্কিল বৃদ্ধি করার জন্য শিক্ষক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। এত বেকারের সংখ্যা কারণ আমাদের পড়াশোনার সিলেবাস জব মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ী ডিজাইন করা হয় না। যেখানে কমিউনিকেশন স্কিল, সহযোগিতার মানসিকতা, দ্রুত সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী গুরুত্ব পায় চাকরির ক্ষেত্রে সেখানে আমাদের ঘাটতি রয়েছে। ফলে ব্যবসায় শিক্ষার আলাদা চাহিদা থাকছে না। এজন্য কারিকুলামে সফট স্কিলের দিকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ পরিবর্তনশীল যে কোনো পরিস্থিতিতে যেন কমার্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা জব মার্কেটের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৬৮তম। তাই এ সূচকে আমাদের আরও উন্নতি ঘটাতে হবে। বিভিন্ন দপ্তরে নাগরিক সেবা পেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি করতে পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কমিয়ে আনাও জরুরি। তরুণরা যদি ব্যবসায় আসতে আগ্রহী হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ব্যবসায় শিক্ষায় পড়তে বা পছন্দ করতে উৎসাহ পাবেন। কারণ যারা ব্যবসায় শিক্ষায় পড়াশোনা করে উদ্যোক্তা হবেন তারা সাধারণত ব্যবসায়ের অনেক ক্ষেত্রে সফল হতে পারেন।
মানুষের জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব ও অনেক কিছু অটোমেশন হওয়ার কারণে যন্ত্র ও প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরতাও বেড়েছে। এ কারণে কম্পিউটার বিজ্ঞান, সফটওয়্যার প্রকৌশল, তড়িৎ প্রকৌশলের মতো বিষয়ে চাকরির বাজার ও শিক্ষার্থীদের আবেদন বেশি থাকে। কিন্তু এর পাশাপাশি ডেটা সায়েন্স, এআই, আইওটি, রোবোটিক্সের মতো বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিত অনেক গুরুত্ব পায়। অর্থাৎ সব বিষয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত সমন্বিত করে পড়ানো দরকার।
তার মানে ব্যবসায় শিক্ষায় এ সকল প্রযুক্তির আলোচ্যসূচি সমন্বিত করে কোর্স ডিজাইন করা প্রয়োজন। যেমন ফিনটেক ব্যবসায় শিক্ষায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ব্যবসায় শিক্ষাকে বিজ্ঞানভিত্তিক করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে ব্যবসায় শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে। সকল ডিগ্রির মধ্যেই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গণিত আনতে হবে। শুধু থিওরি পড়ালে হবে না, ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যবসায় শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ