উনিশ শ’ সাতান্ন সালে নির্মিত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জলাধার
উনিশ শ’ সাতান্ন সালে নির্মিত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জলাধার বা লেকে বিলীন হওয়া গ্রাম, জনপদ, ফসলি জমি থেকে উদ্বাস্তু হওয়া ছিল পাহাড়িদের ভূমি অধিকারের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত। ব্রিটিশ আমল থেকে ভূমির স্থায়ী মালিকানা নিয়ে পাহাড়িদের সঙ্গে নানা ধরনের ছলচাতুরী চলেছে। ব্রিটিশ আমলের আগে এদের ভূমি ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে অস্থায়ী ব্যবহারের অধিকার বণ্টন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার আঠারো শ’ পঁয়ষট্টি সালের ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ফরেস্ট অ্যাক্ট ও পরের আরও কয়েকটি আইনের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় সব জমি রাষ্ট্রীয় মালিকানার বলে ঘোষণা করে।
আঠারো শ’ পঁচাত্তর সালের মধ্যে একে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা Reserve forest এবং জেলা বনাঞ্চল বা District Forest নামে দু’ভাগ করে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পাহাড়িদের জীবনযাপনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড যেমন জুম চাষ, ফলমূল চাষ, শিকার ইত্যাদি নিষিদ্ধ হয়। বসবাসের জন্য নির্ধারিত হয় জেলা বনাঞ্চল। তবে এখানে বসবাসের অনুমতি দিলেও এর ওপর পাহাড়িদের মালিকানার আইনি অধিকার ছিল না। আইনের দৃষ্টিতে এ ছিল খাস জমি। যার অর্থ প্রশাসন চাইলে যে কোনো সময় এ ভূমি কেড়ে নিতে পারে। অর্থাৎ জন্ম-জন্মান্তর ধরে বাস করে আসা নিজস্ব ভূমিতে পাহাড়িরা হয়ে পড়ে অস্থায়ী বসবাসকারী।
তবে বিশ শতকের শুরু থেকে পাহাড়িদের জুম চাষ ছেড়ে লাঙ্গল দিয়ে চাষে উৎসাহিত করতে ভূমির ওপর ব্যক্তি ও যৌথ মালিকানা দেওয়া শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। উনিশ শ’ সালে প্রবর্তিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধান’-এ বহিরাগত অপাহাড়িদের নামেও ভূমি নিবন্ধন করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এতে সমতল ভূমি থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কয়েক বছরের মধ্যেই এ আইনের সংশোধনী আনা হয়, যাতে অপাহাড়িদের জমি লিজ দেওয়া বা হস্তান্তরের ওপর কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
উনিশ শ’ একাত্তরের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সরকারের ‘চট্টগ্রাম বিধান’-এর চৌত্রিশ নম্বর ধারায় ব্যাপক সংশোধনী আনা এবং উনিশ শ’ ঊনআশি সালে বাংলাদেশ সরকারের ওই একই ধারার শর্তগুলো শিথিল করে দেওয়ায় অপাহাড়িদের পাহাড়ে প্রবেশ এবং পাহাড়ি জমির বন্দোবস্ত পাওয়ার পথ শুধু খুলেই গেল না, তা হয়ে যায় প্রায় অবাধ।
আশির দশকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে অপাহাড়িদের পাহাড়ে পাঠানোর দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়। এই বাঙালি অভিবাসীদের পাহাড়ে উৎসাহিত করতে পাহাড়ে জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু লাখ লাখ অভিবাসীকে দেওয়ার মতো জমি পাহাড়ে ছিল না। সুতরাং হাত পড়ল পাহাড়িদের ব্যক্তি ও যৌথ মালিকানার জমিতে। কোনো ধরনের ভূমি সংস্কার ছাড়া এগুলো জোর করে বাঙালি অভিবাসীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এতে ভূমিহীন হয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ। এই জাতিগত নিপীড়ন এখনো চলছে। খাগড়াছড়িতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা কমতে কমতে ওই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। ওদের সঙ্গে কথা বললে টের পাওয়া যায় ওদের ভেতরের চাপা কান্না।
যদিও সরকারীভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের মূল স্রোতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে। এখানে সামাজিক-রাজনৈতিক সব কর্মকা-ে পক্ষ দুটিÑ পাহাড়ি বনাম বাঙালি। নানা অজুহাতে বাঙালিরা পাহাড়িদের উত্ত্যক্ত করে। দীর্ঘ বঞ্চনা এবং আন্দোলন-সংগ্রামের পর উনিশ শ’ সাতানব্বই সালে যে ‘শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় তাতে পাহাড়িদের জায়গা অবৈধ দখল থেকে মুক্ত করে তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। বলা হয়েছিল ভূমি কমিশন গঠন করে বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে। তা গঠন করাও হয়েছিল। ভূমি কমিশন আইনও প্রণয়ন হয়েছে, কিন্তু পাহাড়িদের জমি পাহাড়িদের কাছে আর ফিরে যায়নি।
পাহাড়িদের নিজস্ব এসব সুখ-দুঃখের মধ্যেই শীত এলে আমরা সমতলের মানুষেরা অনেকেই বেড়াতে ছুটি পাহাড়ে। এর অনন্য সৌন্দর্যে মুগ্ধ হই। এমনই এক সৌন্দর্যের আকড় সাজেক ভ্যালি। সাজেকের প্রকৃতি সমৃদ্ধ হলেও সাধারণ মানুষের অবস্থা প্রায় দীনহীন। পর্যটন শিল্পের স্বাভাবিক বিকাশ হলে একে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে পারত এখানকার আর্থিক জীবন। স্থানীয় অধিবাসীরা ‘মিজো’ নৃ-গোষ্ঠীর। যারা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করেন তাদের প্রায় সবার রয়েছে দ্বৈত নাগরিকত্ব। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিক তারা। সাজেকে কটেজ বা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করছেন, আবার ভারতের মিজোরামেও তাদের ব্যবসা রয়েছে। ছেলেমেয়েরা মিজোরামে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে।
তারা ইংরেজিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। বাংলা বলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা। রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার ইউনিয়ন হলেও ঢাকা থেকে সাজেক যাওয়ার সোজা পথ খাগড়াছড়ি হয়ে যাওয়া। খাগড়াছড়ি জেলার উত্তর-পুবে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা দুটি গ্রাম রুই-লুই এবং কংলাকপাড়া নিয়ে সাজেক ইউনিয়ন। যেতে-আসতে সেনাসদস্যদের কড়া নজরদারি পেরোতে হয়। ভ্রমণার্থীদের কয়েকটি গাড়ি সেনাবাহিনীর চেক পয়েন্টে জড়ো হলে সেনাসদস্যের গাড়ি কর্ডন করে সাজেকে পৌঁছে দেয়।
দার্জিলিং এর কথা মনে পড়িয়ে দেয় সাজেক ভ্যালির দলবেঁধে মেঘ ছুটছে আকাশের এদিক থেকে ওদিক। ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে পাহাড়ি অরণ্য ছাপিয়ে লোকালয়ে। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে মেঘের এমন রঙের খেলা মনে পরিয়ে দেয় সত্যজিৎ রায়ের প্রথম রঙিন ছবি ‘কাঞ্চন জঙ্ঘা’র কথা। হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম চূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার আলো-আঁধারীকে ক্যামেরায় তিনি যেভাবে খেলিয়েছেন বাংলা সিনেমার ইতিহাসে তা আজও স্মরণীয়। কলকাতা থেকে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে আসা এক উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মনে শহুরে কৃত্রিমতা ও সংকীর্ণতা যে কুয়াশাচ্ছন্নতা সৃষ্টি করেছে দার্জিলিংয়ের মেঘলা আকাশের পটভূমির সঙ্গে তা তিনি সমান্তরালভাবে মিলিয়ে ক্যামেরায় তুলে এনেছেন।
মেঘলা প্রকৃতি যেন মেঘাচ্ছন্ন মনেরই প্রতীক। আবার মেঘ কেটে কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রমশ উজ্জ্বল হলে ঘটনার পরম্পরায় মানুষগুলোর মনও মুক্ত হয় সব সন্দেহ-সংশয়, ভীরুতা ও সংকীর্ণতা থেকে। কেটে যায় গ্লানির কুয়াশা। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে তারা। সত্যি, প্রকৃতির অসীম ক্ষমতা রয়েছে দৈনন্দিনতার ক্লান্তি ঘুচিয়ে মনকে নতুন আলোর নির্যাসে ভরিয়ে দেওয়ার।
পাশের ছোট্ট দেশ ভূটানতো পুরোটাই পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুইস আল্পস পাহাড়ি উপত্যকার সুইজারল্যান্ড যাদের হাতছানি দেয় কিন্তু সময়, সুযোগ ও অর্থের সমন্বয় হয়ে ওঠে না তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ছোট্ট দেশ ভুটান। ঘর থেকে বেরিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেতে যত সময় লাগে তার চেয়ে কম সময়ে পৌঁছা যায়। সর্বোচ্চ পঁয়ত্রিশ মিনিট আকাশে ওড়া। সমুদ্র পিঠ থেকে সাত হাজার তিন শ’ বিরাশি ফুট উঁচু পারো বিমানবন্দরে পা রাখার অনুভূতি একেবারেই অন্যরকম।
স্তব্ধতার সব সুর আর প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য মুহূর্তে ভাসিয়ে নেয়। বিভ্রম জাগে এ সত্যি নাকি সিনেমার ক্যামেরাবন্দি দৃশ্য! পাহাড় আর উপত্যকার বাঁকে বাঁকে উপচে পড়ছে সৌন্দর্য। পারো, থিম্পু, পুনাখা, পব্জিখা, দো-চুলা ইত্যাদি উল্লেœখযোগ্য দেখার জায়গার সবখানে উজ্জ্বল আকাশ আর সবুজ পাহাড়ি দিগন্তের মায়াময় হাতছানি। সত্যিকারের আকাশ যে শিল্পীর ক্যানভাসের রং ছাপিয়ে যেতে পারে ভুটানের আকাশ দেখলে তা বিশ্বাস করতেই হবে। রাস্তার ধারে উইলো গাছের সারি আর পাহাড়ি পারো নদীর তীর ঘেঁষে উঁচু-নিচু পথে যেতে যেতে মনে হবে যেন পৌঁছে গেছি এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড অথবা গল্পে বলা কোনো রূপকথার দেশে।
আটত্রিশ হাজার তিন শ’ চুরানব্বই বর্গকিলোমিটারের দেশে জনসংখ্যা সাত লাখের কাছাকাছি। শতকরা সত্তর ভাগের পেশা কৃষি কাজ। তবে পাহাড়ের গায়ে সবুজ ফসল ফলানো সহজ নয় মোটেই। প্রকৃতির শোভা যত থাক, বেঁচে থাকার সংগ্রাম কিন্তু ভুটানীদের বেশ কঠিন। পাহাড়ের ঢালে ফসল দেখতে দেখতে মনে হয় আমাদের সোনার বাংলায় ফসল উৎপাদনে শ্রম দিতে হয় নিশ্চয় তবে এত কঠিন নয় সে শ্রমের রূপ। সহজ যাওয়া আসা থাকলে ভুটানী কৃষক দেখত আমাদের দেশে কেমন মাঠের পর মাঠ ছেয়ে থাকে সবুজ ধান। ভুটানী পর্যটক দেখত কত বৈচিত্র্যময় আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ওদের জীবন বড় একরৈখিক, বুদ্ধের বাইরে প্রায় কিছু নেই। গোটা জাদুঘরে কেবলই বুদ্ধ-নানা ফর্ম ও বয়ানে।
ওদের ইতিহাস শুরু ষোলো শতকে। তবে ওরা জানে বাংলাদেশ সম্পর্কে। পরিচয় জানতে পেরে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘বাংলাদেশ! ভুটান বাংলাদেশ কা দোস্ত হ্যায়।’ খুশি করার জন্য নয়, একেবারে সাধারণ এক বিক্রেতার সরল উচ্চারণ। মনে হলো ভারতকে ওরা রাশভারি দাম্ভিক দাদার মতো দূরত্বে রেখে দেখে। ওরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে চায়।