সম্পাদকীয়
নদীবিধৌত আবহমান বাংলার উর্বর নরম পলিমাটি ঐতিহ্যিকে ঘেরা। আর প্রমত্ত পদ্মা নদীস্নাত অঞ্চলের আর এক অনন্য সম্পদ। প্রমত্ত পদ্মা আজ বঙ্গভূমির কাল্পনিক শৌর্য। কিন্ত ক্রমেই যেন পদ্মার চিরন্তন রূপ লাবণ্য ফিকে হয়ে আসছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য রূপকল্পে পদ্মা নদীর সুষম শোভাও আর আগের অবস্থায় নেই। নদীমাতৃক এই দেশে নদী ভাঙন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে নিত্য-নতুন বিপত্তি পোহাতে হয়। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে পদ্মা নদী থেকে অপরিকল্পিত উপায়ে বালু উত্তোলনের ফলে বাড়ছে নদী ভাঙন, দুর্ভোগে পড়ছেন নদীর তীরে বসবাসকারী মানুষ। নদী পাড়ের জনগোষ্ঠীর জীবনÑজীবিকায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তৈরি হচ্ছে নানা অনাকাক্সিক্ষত চাপ। অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে নদী রক্ষার বাঁধও প্রবল হুমকির মুখে পড়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৫০ কোটি টাকায় নির্মিত নদীরক্ষা বাঁধটি সে অঞ্চলের এক নিরাপত্তার বেষ্টনী। স্থানীয়দের অভিযোগ, ভারতীয় সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার পাড়ঘেঁষা বিভিন্ন এলাকায় বালু উত্তোলন নৈমিত্তিক এক বিড়ম্বনা। বালু উত্তোলনের ফলে ভেঙে পড়ছে বাঁধ। তাতে উপচেপড়া নদীর পানিতে ডুবে যাচ্ছে ফসলি জমি। ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যাওয়া এবং ঘরবাড়ি নদীর পানিতে ভেসে যাওয়ায় বিপন্ন হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের জীবন। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবন আর স্বপ্ন নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে, ভিটেমাটি হারিয়ে রাস্তায় নামছেন কেউ কেউ।
বাঁধ ভাঙ্গার ঝুঁকি থাকলে কিংবা কিয়দংশ ভেঙে গেলেও বালু উত্তোলনে বিরাম নেই। নানা ওজর- আপত্তির মুখে এমন অনৈতিক, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেও কোনো সফল কিংবা সুরাহা হয়নি বলে স্থানীয়দের ক্ষোভ রয়েছে। সমাধান তো দূরের কথা, বরং বাধা দিতে গেলে উল্টো হুমকি দিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী কর্তৃপক্ষ। নদীর চারপাশে বালু তোলার ফলে একদিকে যেমন নদী তার স্বাভাবিক রূপ হারাচ্ছে, বিপরীত দিকে বাঁধের নিচে তৈরি হচ্ছে গর্ত, যা উদ্বেগজনক। বাঁধের ঝুঁকিতে অনেকের জীবন-জীবিকার বিপন্নতার আশঙ্কাও বাড়ছে। এক্ষেত্রে ঝামেলা পাকাচ্ছে অনৈতিক কর্মকা-। বাঁধের এক স্থান ইজারা নিয়ে অন্য জায়গা থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এমন সব নিয়মবহির্ভূত কাজেও আর্থিক লেনদেন লুকোছাপা কিছু নয়। তাই প্রশ্ন উঠেছে ৩৫০ কোটি টাকার বাঁধ সুরক্ষা কতটুকু জরুরি?
ইতোমধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে ৫ দফা দাবিসহ স্মারকলিপি পেশ করা হয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে বালু উত্তোলনকারী পক্ষও তাদের যৌক্তিক মতামত সাপেক্ষে বিক্ষুব্ধ জবাব দিতে কসুর করছে না। তবে বসতবাড়ি, ফসলি জমি, বাঁধ ও নদীতীরবর্তী জনপদ যদি হুমকির মুখে পড়ে তা হলে বালু উত্তোলন বন্ধ করার আশ্বাস দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নদী বাংলাদেশের প্রাণ, উজ্জীবনী শক্তি। সেখানে অনাকাক্সিক্সক্ষত কোনো কাজ যা সামগ্রিক ব্যবস্থাকে নয়-ছয় করে দেবে তেমন অনৈতিক কর্মযোগ প্রতিহত করাও সময়ের দাবি।