মাহবুব নাহিদ (রাজনৈতিক বিশ্লেষক)
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপির চলমান ভূমিকাকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট যে, দলটি তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের সুফল আজ ভোগ করছে। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়নে যে দূরদর্শিতা দেখিয়েছে, তা তাদের এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ৫ আগস্টের আগে এবং পরে বিএনপির রাজনৈতিক পরিপক্কতার যথেষ্ট প্রমাণ রেখেছে। বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম, জনমুখী কর্মসূচীর মাধ্যমে বিএনপি ইতিমধ্যে যথেষ্ট আলোচনায়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার এবং "স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট" সরকারের পতনের জন্য যে এক দফার দাবি তুলেছিলেন, সেই দাবীই ৩ আগস্ট ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে তোলা যায়। ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই, বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের রাজনৈতিক দাবিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি নিয়ে কয়েক বছর ধরে চলমান আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তারা তখন সরকারের পদত্যাগকে চূড়ান্ত বা এক দফা দাবি হিসেবে ঘোষণা করে।
শুধুমাত্র এক দফা দাবীই নয়। বহু আগে থেকেই বিএনপি বারবার রাষ্ট্র গঠনে তাঁরা কী ভূমিকা রাখতে চায় সেটা নিয়ে কথা বলে আসছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রস্তাবিত ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা আজকের দিনেও একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে যা তিনি আগেই ঘোষণা করে রেখেছিলেন। এই দফাগুলোতে শুধু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন নয়, বরং বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, মানবাধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতার মতো মৌলিক বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। এখন যেসব রাজনৈতিক বা সামাজিক সংগঠন "রাষ্ট্র সংস্কার" নিয়ে কথা বলছে, তাদের বেশিরভাগ প্রস্তাবনা তারেক রহমানের ৩১ দফার সাথেই সাদৃশ্যপূর্ণ।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে '২৭ দফা কর্মসূচি' ঘোষণা করেন। এই কর্মসূচি বিএনপির ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার ভিশন এবং রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা হিসেবে তৈরি করা হয়। পরে চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সুশীল সমাজের মতামত এবং দেশের জনগণের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আরও চারটি দফা যোগ করে কর্মসূচিটি ৩১ দফায় রূপান্তরিত করা হয়। তবে এই ৩১ দফা ২০১৭ সালে প্রকাশিত বিএনপির চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০ এর রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা। এর সাথে যুক্ত থাকেন বিএনপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী দেশের সকল রাজনৈতিক শক্তি।
৩১ দফা কর্মসূচি দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনর্গঠন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, এবং জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা ও অনিয়মের সমাধান হিসেবে একটি কার্যকর দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
৩১ দফায় ঘোষিত "সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্রসত্ত্বা" বা “রেইনবো নেশন" গঠনের মাধ্যমে সকল জাতি, সম্প্রদায়, ধর্ম ও বর্ণের সমন্বয় ও সেতুবন্ধনের মাধ্যমে একটা ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠন সম্ভব। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা ৩১ দফার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়াও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংবিধান সংস্কার, মানবাধিকার সুরক্ষা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ অনেক ইতিবাচক বিষয় রয়েছে এতে।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের ব্যবস্থা এবং প্রধানমন্ত্রী পদে একই ব্যক্তি দুইবারের বেশী না থাকার বিষয়টা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরো সুসংহত করবে। কৃষি এবং শিক্ষা খাতের জিডিপি নির্ধারণসহ নানান পদক্ষেপের কথা বলা আছে এতে। ৩১ দফায় “ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট” নামক চমৎকার কথা বলা হয়েছে কোনো একটি দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি যখন শ্রমশক্তিতে পরিণত হয় অর্থাৎ পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার বেশি হয় তখন সেই অনুপাতকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে।
সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রাষ্ট্র সংস্কার, কৃষি, শিক্ষা, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগসহ পুরো দেশের কাঠামোর উন্নয়নে সকল দিকেই চমৎকারভাবে বলা হয়েছে। ৩১ দফা হতে পারে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সনদ। ৩১ দফা এখন বিএনপির বলার মতো একটা গল্প। এই গল্প যে বিএনপি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের আগেই বলে রাখতে পেরেছিল তা তাদের রাজনৈতিক বিজয় বললেও খুব একটা ভুল হবে না।
বিএনপি বর্তমানে একমাত্র রাজনৈতিক দল যাদের জনগণের কাছে যাওয়ার মতো সুসংগঠিত পরিকল্পনা ও রূপরেখা রয়েছে। এই দল জানে, জনগণ শুধু পরিবর্তনের ডাক নয়, বরং একটি সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা দেখতে চায়। বিএনপির নেতারা তাদের এই রোডম্যাপ নিয়ে প্রতিনিয়ত জনগণের সাথে যুক্ত হচ্ছেন, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছেন। অন্যদিকে, বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো এখনো জনগণের সামনে সুস্পষ্ট কোনো রুপরেখা বা কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এখন বিএনপি একমাত্র দল যারা নির্বাচনের জন্য বাস্তবিক অর্থে প্রস্তুত। এই প্রস্তুতি শুধুমাত্র নির্বাচনী প্রচারণার জন্য নয়, বরং দেশ পরিচালনার জন্য। বিএনপির এই "রেডি প্রোডাক্ট" তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।
বিএনপির ইতিহাসের পথচলা শুধুমাত্র আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং রাষ্ট্রের মূল কাঠামোকে সঠিক পথে পুনর্নির্মাণের প্রতিশ্রুতির গল্প। এই দলটি এখন কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, বরং দেশের লাখো মানুষের আশার বাতিঘর। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক। বিএনপির চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান সবসময় তৃণমুল নিয়ে ভাবেন, তৃণমুলই তাঁর কাজের মূল শক্তি। তাই বিএনপির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের সাথে তাদের আত্মিক যোগাযোগ। এই যোগাযোগের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বিএনপি আজও সংগঠিত এবং ঐক্যবদ্ধ। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির জন্য বিএনপি যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে তখন কাজ করেছে। এমনকি রাষ্ট্র ক্ষমতার বাহিরে থেকেও বিএনপি সর্বদা মানুষের জন্য কাজ করেছে। বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র তথা ভোটের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর পুরো জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। অমানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েও মানুষের অধিকার আদায়ের পথ থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাড়াননি তারেক রহমানও।
এমনকি বিএনপির দেশের বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হয়েও মানুষের দ্বারে দ্বারে যাওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন যে, দলের সামনে এখন ফাকা জায়গা নেই, সামনে দেওয়াল আছে, তা অতিক্রম করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার জন্য বিএনপি মনে করে যে নির্বাচনই একমাত্র রাস্তা। তাই তো ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে তিনি জোরেসোরে মাঠে নামিয়েছেন নেতাকর্মীদের।
এখন সময়ের দাবি একটাই—গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সংগ্রামের সফল বাস্তবায়ন। দেশ ও জাতি আজ তাকিয়ে আছে এমন এক ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে ৩১ দফার আলোকে রাষ্ট্র সংস্কার হবে, যেখানে জনগণের ইচ্ছাই হবে শাসনব্যবস্থার মূলে, এবং যেখানে এক উন্নত এবং প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
আর কে