বিশ্ব নেতারা মানবতা ও মানবিকতার কথা প্রায়শই বলেন। তবে মানবিকতা ভূলন্ঠিত হয় ফিলিস্তিন নামে। ফিলিস্তিনের ভাগ্য এবং এর ভবিষ্যৎ কী হবে - এ প্রশ্ন কেবল মধ্যপ্রাচ্যের নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিন সমস্যা একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সংকট যা বছরের পর বছর ধরে বৈশ্বিক রাজনীতি এবং মানবাধিকার ইস্যুর কেন্দ্রে অবস্থান করছে। ইসরায়েলের সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ফিলিস্তিনিদের দ্বন্দ্বের ফলে সৃষ্টি হওয়া মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট আজও সমাধানের অপেক্ষায়। তাই, "কোন পথে ফিলিস্তিন?" এই প্রশ্নটি ভাবনার গভীরে নেওয়া দরকার। মার্কিন নির্বাচনে ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় হোয়াইট হাউজের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে। তার এই বিজয়ের পর বিশ্বের মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে৷
ফিলিস্তিন সংকটের ইতিহাস শতাব্দীপ্রাচীন। এটি মূলত ১৯১৭ সালে বালফোর ঘোষণা এবং পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই প্রকট আকারে দেখা দেয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়, যার ফলে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি নিজেদের ভূমি হারিয়ে শরণার্থী হয়ে যায়। এ ইতিহাস বর্তমান সংকটের শিকড় যেখানে ইহুদি জনগণের জন্য একটি নিজস্ব রাষ্ট্রের চাহিদার মুখোমুখি আরব জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার খর্ব হয়।
বর্তমান সময়েও ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। ইসরায়েলের অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসতি সম্প্রসারণ, গাজার কঠোর অবরোধ এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ, এই সংঘাতকে আরও গভীর করেছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগেও এ সংঘাত সমাধানে তেমন অগ্রগতি হয়নি। গাজায় সংঘর্ষ, ইসরায়েলের দখলকৃত ভূমিতে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং উভয় পক্ষের নিরীহ মানুষের প্রাণহানি অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন হাজারো ফিলিস্তিনি জীবন দিলেও নীরব বিশ্ব। বলা যায় বিশ্ব মানবাধিকার বা মানবতা ফিলিস্তিনের বিষয়ে একরকম বোবা। এই সংঘাত প্রায় দ্বিগুন হয় গত কয়েক বছরে। বিশ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও যুদ্ধ-সংঘাত সহ যেকোন বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের প্রভাব বিরাজমান। সুতরাং, মার্কিন ক্ষমতার পালাবদলে ফিলিস্তিনের ভাগ্যের কিরকম পালা বদল হতে পারে তা নিয়ে সন্দিহান বিশ্ব। যদিও যুদ্ধ বন্ধ করতে ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করবে ট্রাম্প প্রশাসন এমনটাই বলা হয়েছিলো ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা ও ইশতেহারে। সেটা কতটা বাস্তবায়ন হবে এবং আদৌ মধ্য প্রাচ্যে শান্তি ফিরে আসবে কি না তা সময় ই বলে দিবে। অনেকের মতে ট্রাম্প যুদ্ধ পুরোপুরি থামাতে সক্ষম না হলেও ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারবে।
ফিলিস্তিন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বহুমুখী। বেশিরভাগ দেশ ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ইসরায়েলের শক্তিশালী মিত্র এবং জাতিসংঘে ইসরায়েলের পক্ষে বারবার ভেটো দিয়েছে। অপরদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো বিভিন্ন সময় ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ালেও নিজেদের স্বার্থে তা অনেক সময় সীমাবদ্ধ থেকেছে। তাই সংকট সমাধানে অগ্রণী ও কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না প্রভাবশালী কোন দেশ৷
যদি সমাধানের দিকে যাওয়া যায় তবে দুই রাষ্ট্র সমাধানই হচ্ছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ম্যান্ডেট। এটি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এবং একটি নিরাপদ ইসরায়েল রাষ্ট্রের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু এই সমাধান বাস্তবায়নে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন বসতি সম্প্রসারণ এবং জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ। এছাড়া এক রাষ্ট্র সমাধানের ধারণা ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের একই রাষ্ট্রে বসবাসের কথা বলে, যেখানে সমান নাগরিক অধিকার থাকবে। তবে এই সমাধান অনেক ইসরায়েলির কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং এর ফলে ইহুদি রাষ্ট্র ধারণার অবসান ঘটতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন।
সংকট সমাধানে মধ্যস্থতাকারী শক্তির মাধ্যমে আলোচনা ও সংলাপ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা এবং আর্থিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে উভয় পক্ষকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে আনতে হবে। মানবাধিকার, ন্যায্যতা ও আইন অনুযায়ী ফিলিস্তিনিদের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এই সংঘাতের প্রধান ভুক্তভোগী সাধারণ ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি জনগণ। সংঘাতের কারণে শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের জীবন বিপর্যস্ত। গাজার মতো জায়গায় প্রতিদিনের জীবনে নিরাপত্তা এবং মৌলিক চাহিদা মেটানোর সংগ্রাম করছে মানুষ। এ কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বৃহত্তর মানবসমাজকে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন বাড়াতে হবে। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ফিলিস্তিন সংকট নিরসন প্রাধান্য পাবে।
যদি ট্রাম্পের দিকে ফিরে আসি তাহলে ২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস সেখানে স্থানান্তর করে। এই সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনি জনগণ এবং বেশিরভাগ মুসলিম দেশগুলোর জন্য বড় ধাক্কা ছিল, কারণ তারা পূর্ব জেরুজালেমকে ভবিষ্যৎ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দেখে। ২০২০ সালে ট্রাম্প তার প্রশাসনের প্রস্তাবিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা উন্মোচন করেন, যা 'ডিল অফ দ্য সেঞ্চুরি' নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসন সীমিত এবং ইসরায়েলের জন্য বড় এলাকা অধিকার রাখার কথা বলা হয়েছিল। ফিলিস্তিনিরা এই পরিকল্পনাকে একতরফা এবং তাদের স্বার্থবিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। সুতরাং, ২য় বার ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প কেমন সিদ্ধান্ত নেয় তা নিয়ে বেশ জটিলতা আছে।
ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কোনো সহজ বা সোজা পথে নয়। ‘কোন পথে ফিলিস্তিন?’ এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সংলাপ, ন্যায়বিচার এবং সম্মানের ভিত্তিতে একটি কার্যকর ও টেকসই সমাধান প্রতিষ্ঠার উপর। দীর্ঘদিনের অন্যায় ও সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তি, মানবতা এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পথে আমাদের সবাইকেই ভূমিকা রাখতে হবে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ