বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বহুকাল ধরে প্রাত্যহিক জীবনে গেঁথে গেছে। কিন্ত এই সুবিধাজনক ব্যাগগুলো আজ আমাদের পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি সৃষ্টি করেছে। প্লাস্টিক উৎপাদন থেকে শুরু করে ব্যবহৃত পলিথিনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মোট বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাসের ৪% নির্গমন করে, যা প্রতিনিয়ত মানব স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং প্রাণিকূলের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে প্লাস্টিক এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান এবং খাদ্য শৃঙ্খলের ওপর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে।
পলিথিন ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এই বিপুল পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন-ডাই অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮৭,০০০ টন একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার ৯৬% সরাসরি বর্জ্য হিসেবে নিষ্কাশিত হয় এবং এসব বর্জ্যের মধ্যে ৩৬% পুনর্ব্যবহারযোগ্য, ৩৯% মাটির নিচে জমা করা হয় ও ২৫% সমুদ্র এবং অন্যান্য জলাভূমিতে প্রবেশ করে। প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে মাটি ও পানি দূষিত হচ্ছে, যা কৃষি ও জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। প্রতি বছর ১ মিলিয়ন সামুদ্রিক পাখি প্লাস্টিক দূষণের কারণে মারা যায় এবং ১ লাখ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে মারা যায় (ইউনেস্কো)। তাছাড়াও প্রতি বছর সমুদ্রে ১ কোটি ৩০ লাখ টন প্লাস্টিক মেলে, অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে ২০৬ কেজি (জাতিসংঘ)। তাই পলিথিন নিষিদ্ধকরণ হলেও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের (সংশোধিত) ধারা ৬ক অনুযায়ী, পলিথিন এবং একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পেয়েছে। এর অধীনে, সরকার একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে মুদি দোকানগুলোতে একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এবং সমস্ত সরকারি অফিসে প্লাস্টিকের পানির বোতল ব্যবহার বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব বিকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আইন অমান্যকারীদের জন্য আর্থিক জরিমানা বা কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
কিন্ত বাস্তবায়নে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিকল্পের অভাব। এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা অনেকটা এই রকম যে, চিকিৎসার জন্য ব্যথানাশক দিয়েছি, কিন্ত রোগ সারাতে কার্যকর ওষুধ এখনো হাতে নেই। সরকার যখন পলিথিন নিষিদ্ধ করে, তখন পর্যাপ্ত বিকল্প না থাকায় ভোক্তাদের নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তাই, শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ নয়, বরং সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য বিকল্প সরবরাহও একান্ত প্রয়োজন।গাছে ফল ধরার আগে যত্ন নিতে হয়, আর কুঁড়ি ফোটার পর সঠিক পরিচর্যা করলে তা একদিন বড় গাছে পরিণত হয়। আমাদের বিকল্পের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।
পলিথিন ব্যাগের বিকল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া যেতে পারে :
১. জৈবপচনশীল: এমন উপাদান ব্যবহার করতে হবে যা সহজেই মাটির সাথে মিশে যায়।
২. কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো: উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কার্বন নিঃসরণ যতটা সম্ভব কম রাখতে হবে।
৩. পুনঃব্যবহারযোগ্যতা: এমন উপকরণ ব্যবহার করতে হবে যা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে বারবার ব্যবহার করা যায়।
এসব মানদণ্ডের মধ্যে যা সবচেয়ে টেকসই, সেটিকেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে গুরুত্ব দেয়া উচিত।
উন্নত দেশগুলোতে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে বায়োডিগ্রেডেবল পলিমার, পেপার ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার শুরু হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে জৈবিক পলিমার ব্যাগ এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য স্টিলের বোতল ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এছাড়া, উন্নত দেশগুলো বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়াচ্ছে, যা দ্রুত মাটিতে মিশে যায় এবং পরিবেশ দূষণ কমায়।
বাংলাদেশে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব ব্যাগের ব্যবহার বাড়ানো হলে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে ৮ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে পাট চাষ হয়। পাট শিল্পে বিনিয়োগ ও গ্রামীণ নারীদের যুক্ত করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে, যা পাট, কাগজ এবং কাপড়ের ব্যাগ তৈরির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি মজবুত করবে।পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন এর বিকল্প ব্যবহার। নিচে কিছু টেকসই ও পরিবেশবান্ধব বিকল্পের উল্লেখ করা হলো:
১.পাটের ব্যাগ: বাংলাদেশে উদ্ভাবিত সোনালি ব্যাগসহ পাটজাত ব্যাগ টেকসই, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং সহজেই ক্ষয়ে যায়।
২.কাগজের ব্যাগ: পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও দ্রুত ক্ষয়যোগ্য হওয়ায় এগুলো হালকা ব্যবহারযোগ্য পণ্য বহনে উপযুক্ত।
৩.তুলার ব্যাগ: দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারযোগ্য, ধোয়া যায়, এবং জৈব উপায়ে তৈরি করা সম্ভব।
৪.ক্যানভাস ব্যাগ: তুলা বা লিনেন থেকে তৈরি টেকসই ব্যাগ, যা বারবার ব্যবহার করা যায়।
৫.কচুরিপানার ব্যাগ: বায়োডিগ্রেডেবল এবং দ্রুত পুনর্ব্যবহারযোগ্য, যা স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করে।
পলিথিনের জনপ্রিয়তার মূল কারণ এটি সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য। এই পণ্যটি উৎপাদন ও ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হলে সাশ্রয়ী বিকল্প তৈরি করতে হবে। বর্তমানে পাট, কাপড় এবং কাগজের ব্যাগ এর বিকল্প হতে পারে। কিন্ত এগুলো সহজলভ্য না হলে ক্রেতারা তা গ্রহণ করবে না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। এর বাইরেও অনুমতি ছাড়া প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে বেশ কয়েক হাজার।পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করলে অনেক কারখানা বন্ধ হবে, যা দেশের অনেক মানুষকে বেকার করে তুলবে। ফলে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করলে সরকারের পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে পারে। তাই কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য পলিথিন কারখানাগুলোকে পাট বা কাগজের ব্যাগ উৎপাদনের দিকে পরিচালিত করতে হবে।
যদিও বাণিজ্যিকভাবে পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ উৎপাদন এখনো সম্ভব হয়নি, ক্ষুদ্র পরিসরে বিভিন্ন উদ্যোগ ইতোমধ্যেই গৃহীত হয়েছে। তবে উচ্চ উৎপাদন খরচের কারণে এগুলো কার্যকরভাবে বাজারে স্থান করে নিতে পারছে না। উল্লেখযোগ্য উদ্যোগগুলোর মধ্যে রাজশাহীতে ভুট্টার স্টার্চ থেকে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এই ব্যাগগুলো সম্পূর্ণ জৈবপচনশীল এবং স্বল্প সময়েই মাটিতে মিশে যায়। একইভাবে ঢাকার ডেমরায় পাট থেকে বায়োপলিমার ব্যাগ তৈরি হচ্ছে, যা ‘সোনালী ব্যাগ প্রকল্প’ নামে পরিচিত। এই প্রকল্পের আওতায় তৈরি ব্যাগগুলো দেখতে পলিথিনের মতো হলেও এগুলো পরিবেশবান্ধব এবং সহজেই ক্ষয়ে যায়। তাই পলিথিনের বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারে। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ এবং কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে কাগজ, কাপড় এবং পাটের ব্যাগ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি সম্ভব।
বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, তবে এটি কার্যকর করতে বিকল্প পণ্যের সরবরাহ ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। পরিবেশ রক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণ, সরকারের সহযোগিতা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। পাশাপাশি, পলিথিন কারখানার শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা প্রয়োজন। যদি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে সরকারী সহায়তা ও নীতিমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তবে পরিবেশ রক্ষা ও কর্মসংস্থানের চাহিদা একসাথে পূরণ করা সম্ভব। তাই শুধুমাত্র নিষিদ্ধকরণ নয়, বিকল্প পণ্য তৈরির মাধ্যমে সবুজ ও পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
শিক্ষার্থী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়