শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। যুগ-যুগান্তরের প্রবাদ বাক্য। শুধু তাই নয়, বাস্তব জীবন প্রক্রিয়ায়ও এর কোনো ব্যত্যয় জাতির জন্য অশনি সংকেত। জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনের ফলে আগস্টে যে বিজয় নিশানা তা দেশের জন্য পরম উপহার আর অহংকারও বটে। ক্রমবর্ধমান অসহনীয় দেশ শাসনের কর্তৃত্বে লাগাতার ১৫ বছরের পথপরিক্রমা কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক ছিল না। সমাজ ও অর্থনীতিবিদরা বলতে দ্বিধা করেননি হরেক অপকর্ম আর অপসংস্কারে বিদ্যমান সমাজের ভিত নড়ে ওঠা ও ঐতিহাসিক পথপরিক্রমা। সঙ্গতকারণে সেই অতি আদিম প্রাচীন সমাজ থেকে ধাপে ধাপে উত্তরণের বিভিন্ন ঐতিহাসিক যাত্রাপথ এগিয়ে চলার স্বচ্ছ দলিল। যে কোনো সমাজ তার নিজস্ব সংস্কার, কর্মদ্যোতনা আর দীর্ঘ ঐতিহাসিক পালাক্রমের যথার্থ যাত্রাপথ। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম কিছুই নয়। ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ থেকে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে যেন সাড়া জাগানো বিপ্লব দেশের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তাও ইতিহাসের বরমাল্য অবশ্যই। স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের ভিত তৈরিতে দেশের উদীয়মান প্রজন্ম তারুণ্যের মহাশক্তির যে জয়জয়কার, সেটাই নতুন বাংলাদেশের নবরূপ। সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থা আর শিক্ষার্থীদের নিরলস কর্ম সাধনা, সঙ্গে বিপ্লবের ধ্বজা ওড়ানো সব মিলিয়ে এক অনন্য শক্তিময়তার পালাক্রম তো বটেই। পুরনো সমাজের বিদায় আর নতুন সমাজের নব অভ্যুদয় জাতির জন্য বহু কাক্সিক্ষত, আজন্ম লালিত স্বপ্নের এক আবশ্যিক বাতাবরণ। কিন্তু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাঠামোর অভ্যন্তরে জিইয়ে থাকা নানামাত্রিক বিপন্নতাও মাথাচাড়া দেওয়া নতুন কিছু নয়। যে কোনো সৃষ্টিযজ্ঞের যেমন বেদনা থাকে, নব অভ্যুদয়ের আনন্দ বিনোদনও কম কিছু নয়। তার ওপর চেপে বসা পেছনে ফেলে আসা হরেক জঞ্জাল। যে আবর্জনাকে অতি সহজে উপড়ে ফেলা কঠিন এক শক্ত প্রাচীর। তাই অন্তর্বর্তী নতুন সরকার শতদিন পার করার পরও বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের উপস্থিত দুঃসহ পরিস্থিতিও সামনে চলে আসছে। নতুন সময়ের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের যে ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা, তাও উপস্থিত সংকটের উপশম তো বটেই। তবে সমাজের আগামীর ভবিষ্যৎ অফুরান তারুণ্যের শক্তি ছাত্ররা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেও এখনো যথার্থ অর্থে তাদের শ্রেণিকক্ষে ফিরতে না পারাও প্রশ্নবিদ্ধ এক পর্যায়। তাৎক্ষণিক উপস্থিত আর সুচিন্তিত পরিকল্পনায় নবগঠিত সরকার তার কার্যক্রমে সক্রিয় হলেও সব চটজলদি সমাধান সম্ভব হচ্ছে না। সময়ের অপেক্ষমাণ বলয় কত দীর্ঘ হবে, তাও অনির্ধারিত এক যাত্রাপথ। রাজনীতির মেরুকরণ কিংবা সমীকরণ দেশকে যে নতুন পথের সন্ধান দেবে, তার জন্যও ধৈর্য ধরা অত্যন্ত জরুরি। পুরনো সমাজের বিদায়ে যে নতুন সংস্কার কার্যক্রম সামনে অবধারিতভাবে এসে যাচ্ছে, সেখানেও মতৈক্য নিতান্ত জরুরি বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ, অভিমত দিয়ে যাচ্ছেন। যথার্থ অর্থেই দেশ এখন ক্রান্তিকালীন সময় পার করছে। নতুন সরকারেরও স্বস্তি, সহনীয় অবস্থায় থাকা দুঃসহ এক পালাক্রম। দফায় দফায় দাবি দাওয়ায় রাজপথে নেমে আসা ছাত্রা-জনতার ঢল সত্যিই কাক্সিক্ষত নয়। সবই সময় সাপেক্ষ বিষয়। তড়িঘড়ি করে রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার, পরিবর্তন, পরিবর্ধন কঠিন এক বলয়। এই মুহূর্তে দেশে নির্বাচিত সরকারের অনুপস্থিতি জাতির জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। জনগণের নির্বাচিত সরকারই সিদ্ধান্ত, সংস্কার, রূপান্তর সবই করতে পারে আইনগত ও সাংবিধানিক পরিক্রমায়। এর ব্যত্যয় কোনো কিছু সুরাহার পথনির্দেশ না হওয়া বর্তমান পরিস্থিতির বাস্তবতা।
যেহেতু আন্দোলনের সফল নায়ক দেশের অগণিত মেধাবী শিক্ষার্থীর অনন্য বিজয়, ঠিক তেমন অবস্থানে আজও তাদের দাবি আদায়ের যাত্রাপথ মুখর এবং উদ্দীপনামূলক। উচ্চ শিক্ষার পাদপীঠ দেশের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় মেধা ও মননের পরম তীর্থস্থান। সেখানে স্কুল-কলেজের শিক্ষাপাঠও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা সফলতার সিঁড়ি অতিক্রম করে বিশ^বিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশ করে। অংশ নিতে হয় ভর্তি পরীক্ষায়। বলা যায় পরীক্ষা তো নয়, একেবারে ভর্তিযুদ্ধ। তেমন কঠিন যথার্থ পথপরিক্রমায় মেধা ও মননের সর্বোচ্চ পাদপীঠ বিশ^বিদ্যালয়ের সম্মান ও মর্যাদা। সেখানে পবিত্র অঙ্গনটির ওপর জাতির ক্রান্তিকালে প্রাসঙ্গিক দায়বদ্ধতা যেন সামনে চলে আসে।
আজকের উদীয়মান তরুণ ছাত্ররা আগামীর বাংলাদেশের যথার্থ কারিগর। দেশের গৌরব আর সমৃদ্ধির যাত্রাপথের অনন্য অংশীদার তো অবশ্যই। তাই নতুন বাংলাদেশের আধুনিক ও প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটে আবারও ছাত্র সমাজের নবঅভ্যুদয় এক অনির্বাণ আলোকিত দীপ্তি। যার উজ্জ্বলতম কিরণে নতুন বাংলাদেশ যে অনধিগম্য পথকে আলিঙ্গন করছে তার দামও অমূল্য। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থ অভিভাবকের মতো নিঃশর্ত নিবেদনে ছাত্রদের ঐতিহাসিক পদচারণাকে দেশের জন্য সর্বাধিক মঙ্গল বিবেচনায় আনলেন। সমাজের সবক্ষেত্রে সংস্কার, নতুন সময়ের সংযোজক অত্যাবশ্যক, প্রাসঙ্গিক। তবে জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব, মর্যাদা দেওয়াও নতুন যুগের অপরিহার্যতা। শিক্ষার সঙ্গে সন্নিবেশিত করা জরুরি নতুন প্রজন্মের কর্ম ও পেশা। সৃজনশীল শিক্ষা ও কর্মযোগ আধুনিক বাংলাদেশের নতুন কারিগরদের স্বপ্নও বাস্তবায়নের নির্মল সাধনযজ্ঞে রূপ নেবে। এমন আকাক্সক্ষা আর প্রত্যাশায় ছাত্রদের উদ্যোক্তা হতেও বিশেষভাবে প্রাণিত ও আহ্বান করেন। মেধা, মনন আর সৃজন দ্যোতনায় ছাত্ররা একসঙ্গে জ্ঞান রাজ্যে বিচরণ এবং সফল কর্মযোগেও যুক্ত হবে। বিজ্ঞ শিক্ষাবিদ প্রধান উপদেষ্টা আশা করেন, মানুষ আসলে জন্মগতভাবেই উদ্যোক্তা। যা তাকে সৃজনশীল কর্মে উদ্দীপ্ত আর কাক্সিক্ষত করে তোলে। তবে আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষায় নতুন প্রজন্মকে চাকরিজীবী হতে উদ্বুদ্ধ করে। শিক্ষা ব্যবস্থায় উদার আর বহুমুখী নির্দেশনাও যুগের দাবি। বহু পথ আর মতের মধ্য থেকে উদীয়মান প্রজন্ম যাচাই-বাছাই করবে তার আকাক্সক্ষা, লক্ষ্য আর সামনে চলার অনন্য নির্দেশনা। শিক্ষা ব্যবস্থাকে নব সংস্কারে ঢেলে সাজানো জরুরি। যেখানে শুধু চাকরি নয়, ব্যবসা বাণিজ্যের পথও খোলা রাখা সমীচীন।
তারুণ্যের অভাবনীয় শক্তিতেই জিইয়ে থাকে মনন আর সৃজনবোধ। যা তাকে যথার্থ পথের সন্ধান দিয়ে সাবলীলভাবে সামনে এগিয়ে নেয়। যে শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু পরীক্ষানির্ভর হয় তা কোনোভাবেই শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ আশা পূরণে অংশীদার হয় না। যে সম্ভাবনাময় তরুণরা নতুন রাষ্ট্র গঠনে বীরোচিত ভূমিকা রাখে, তারা যে সবক্ষেত্রে পারদর্শী হতে পারে, সেটা আর প্রমাণের অপেক্ষায় নেই। ইতোমধ্যে তা দৃশ্যমান এবং সর্বজনবিদিত। পরীক্ষার নম্বর সবক্ষেত্রে বিবেচ্যও হয় না। বরং মনন আর সৃজন সাধনযজ্ঞের অবিমিশ্র সম্পদই গ্রহণযোগ্যতা পায়। শিক্ষার্থী নিজের গভীরে সুপ্ত থাকা অনেক সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলে সামনের চলার পথকে উন্মুক্ত করতে পারে। শুধু কি তারুণ্য শক্তি? সেখানে অভিভাবকদের অভিজ্ঞতা আর যথার্থ আদর্শের সন্নিবেশিত করাও হবে সময়ের অনিবার্যতা। আধুনিক যুগ পরিকল্পনার পরম নির্মাল্য। সঙ্গত কারণে জাতীয় পাঠক্রমে পারিবারিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, সংস্কারকে একীভূত করা প্রজন্ম আর নতুন দেশ গঠন প্রক্রিয়ার নব অভিযোজন। নবীন-প্রবীণের মধ্যে দুর্ভেদ্য কোনো ব্যবধান তৈরি করাই যাবে না। নতুন-পুরনোর সহজাত মিলন দ্যোতনায় আধুনিক ও শিল্প প্রযুক্তির বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার যেন এক সুতায় গেঁথে যায়। জাতি হিসেবে আবহমান বাংলা এক অভাবনীয় ঐতিহ্যিক পরিমণ্ডল। দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে বাংলার শাশ্বত গৌরব চিরস্থায়ী এক সম্পদ। শুধু কি তাই-ই? স্বাধীন সত্তায় টিকে থাকা এক অপরাজেয় শক্তিমত্তায় বিদেশী আধিপত্যের শিকার না হওয়া বাংলা ও বাঙালির এক অনন্য স্বাধীনচেতার দীপ্ত প্রকাশ। বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান পতনের মধ্যেও অবিভক্ত বাংলা কখনো কারও বশ্যতা স্বীকার করেনি। দূর-দূরান্তের দিল্লির শাসকরা নির্দিষ্ট খাজনার বিনিময়ে সমৃদ্ধ বাংলাকে আপন শৌর্যে টিকে থাকতে কোনো ঝক্কি-ঝামেলাই তৈরি করেনি। আবহমান বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস তারই সাক্ষ্য বহন করে। আরও একটি প্রচলিত ঐতিহাসিক ধারণা ইতিহাসবিদদের লেখায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। উন্নত সভ্যতার ধারক বাংলা নাকি মধ্যযুগের বর্বর বিজয়ীদের দ্বারা কখনো লাঞ্ছিত না হওয়ার ইতিবৃত্ত আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সমৃদ্ধ বাংলার চির উন্নত মম শিরে প্রথম আঁচ লাগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। যারা বাণিজ্যের ছলচাতুরীতে আবহমান দৃঢ়চেতা বাংলা ও বাঙালিকে পরাভূত করার যে বেষ্টনী তৈরি করে, সেটাই পরবর্তীতে পুরো ভারতবর্ষকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আটকে দেয়।
তবে বাংলাকে কেন বশীভূত করা গেল না? দীর্ঘকালীন টিকে থাকা অবিভক্ত ভারতীয় রাজবংশের। ধারণা করা হয়, তারা এসেছিল মধ্যপ্রাচ্যের বর্বর এলাকা থেকে। উন্নত সভ্যতা সংস্কৃতির ধারক বাংলাকে তাই কোনোভাবেই আয়ত্তে আনা সম্ভব হয়নি। আধিপত্য পরের বিষয়। বর্বর বিজয়ীরা নাকি উন্নত সভ্যতার ধারক বাঙালির আবহমান কৃষ্টি সংস্কৃতির কাছে পরাভূত হয়েছে। ব্রিটিশরাই প্রথম জাতি যারা বাংলার সভ্যতা সংস্কৃতি থেকে উন্নত আর সেই কারণে অনধিগম্য। ভাষা, সংস্কৃতি, চিরায়ত মূল্যবোধে নিবিষ্ট বাঙালি কোনো এক পালাক্রমে আলাদা এক ভূখণ্ডে পরিণত হওয়া ইতিহাস, ঐতিহ্যের পরম নির্মাল্য। শুধু কি তাই? নতুন ও আধুনিক প্রজন্ম আবারও প্রমাণ করে দিল দেশে কোনো অরাজক পরিস্থিতি কিংবা লাগাতার অপশাসনের অনুষঙ্গ থাকতেই পারে না। যেখানে প্রয়োজন তেমন অব্যবস্থাপনায় আঘাত করাও ছিল সময়ের অপরিহার্যতা। তবে সফল শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতায় যে যুগান্তকারী অবদানে বাংলাদেশকে নতুন জগৎ উপহার দিল, তারাই আধুনিক প্রযুক্তিতে মাতৃভূমিকে যোগ্য ও উপযুক্ত হয়ে নিত্যনতুন কর্মস্পৃহায় এগিয়ে নিতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে। তবে তার আগে অবশ্যই নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকার্য সম্পন্ন করে যোগ্যতম বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক কর্মযোগকে সামনের দিকে নিয়ে যাবে। যা উত্তরোত্তর দেশের শ্রীবৃদ্ধিতে অবিস্মরণীয় অবদান রাখবে।
লেখক : সাংবাদিক