স্ট্রিমিং পরিষেবা হলো একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যা ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেটে সিনেমা, টিভি শো, সংগীত বা পডকাস্টের মতো বিষয়বস্তু দেখতে বা শুনতে দেয়। ডিজিটাল ডিভাইসে এগুলো ডাউনলোড করার পরিবর্তে সরাসরি ব্যবহারকারীরা রিয়েল-টাইমে স্ট্রিম করতে পারে। বর্তমান বিশ্বে জনপ্রিয় স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে নেটফ্লিক্স (মুভি, সিরিজ), স্পটিফাই (মিউজিক), ইউটিউব (বিনোদন, শিক্ষা, ব্যবসা ইত্যাদি), ডিজনি প্লাস ((মুভি, সিরিজ) ইত্যাদি। তবে নেটফ্লিক্স হলো বর্তমান সময়ের সর্ববৃহৎ এবং সব থেকে বেশি জনপ্রিয় একটি ওটিটি (OTT- Over the Top) প্ল্যাটফর্ম যেটি কি না ইন্টারনেটের মাধ্যমে এবং নির্দিষ্ট সাবস্ক্রিপশনের ভিত্তিতে তাদের গ্রাহককে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস প্রদান করে। এটি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত একটি বিনোদনধর্মী প্রতিষ্ঠান হলেও নেটফ্লিক্সের সম্প্রচার বর্তমানে বিশ্বের ১৯০টি দেশে বিস্তৃত। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৭ সালের ২৯ আগস্ট রিড হ্যাস্টিংস এবং মার্ক রেন্ডোলফ নামের দুজন মার্কিন নাগরিকের হাত ধরে ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের স্কটস ভ্যালি শহরে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। স্বল্পমূল্যে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার সিনেমা, টিভি সিরিজ, অ্যানিমেশন, ডকুমেন্টারি এবং অন্যান্য পরিষেবা প্রদানের মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মটি সারা বিশ্বে এখন খুবই জনপ্রিয়। বর্তমান নেট দুনিয়ায় যত ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বা ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট রয়েছে তার সবগুলোকে ছাপিয়ে সবার শীর্ষে অবস্থান করছে নেটফ্লিক্স। শুধু আমেরিকাতেই নয়, বাংলাদেশ, ভারত, জাপান, উত্তর কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস এবং ব্রাজিলসহ অনেক দেশে আছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়।
নেটফ্লিক্স বর্তমানে সারা বিশ্বের ১৯০টি দেশের ২১টি ভাষায় মুভি ও টিভি সিরিজ প্রচার করে থাকে, যা কোনোরকম বিজ্ঞাপন ছাড়া উপভোগ করা যায়। তবে নেটফ্লিক্সের প্রধান আয় হচ্ছে গ্রাহক রেভিনিউ, গ্রাহকরা প্রতিমাসে ৩ থেকে ১২ ডলার প্রদান করে থাকে। সে হিসাবে নেটফ্লিক্স প্রতিবছর কমপক্ষে ১.৮৬ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। এছাড়া নেটফ্লিক্স তাদের ডিভিডি ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে ৩০-৪৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে। পরিসংখ্যানুযায়ী চলতি বছরে এখন পর্যন্ত প্ল্যাটফর্মটি ১৯০ কোটি ডলার আয় করেছে, যার মধ্যে ৪০ শতাংশ এসেছে বিজ্ঞাপন থেকে। উল্লেখ্য, শুধু বিজ্ঞাপনভিত্তিক সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছে ৪০ মিলিয়ন। সম্প্রতি নেটফ্লিক্স এশিয়া ও ইউরোপীয় বাজারে বিনামূল্যে ভিডিও-স্ট্রিমিং এবং বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের পরিকল্পনা নিয়েছে তাদের সাবস্ক্রাইবার আরও বাড়ানোর জন্য। উল্লেখ্য, নেটফ্লিক্সের শুধু বাংলাদেশেই দুই লাখেরও বেশি গ্রাহক আছে এবং ২০১৮ সালের হিসাবে নেটফ্লিক্স প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ২০০ কোটি টাকা আয় করছে। নেটফ্লিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে তার ব্যবহারকারীগণ ইন্টারনেট সংযুক্ত যে কোনো ডিভাইস যেমন- স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, টিভি, কম্পিউটার এবং ল্যাপটপে যে কোনো মুভি, টিভি সিরিজ, ওয়েব সিরিজ এবং বিভিন্ন ধরনের বিনোদনধর্মী ভিডিও উপভোগ করতে পারে, যেমনটি ইউটিউবের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তবে ইন্টারনেট কানেকশনের মাধ্যমে ইউটিউবে যেভাবে ফ্রি ভিডিওসমূহ উপভোগ করা যায় নেটফ্লিক্সের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। এতে যে কোনো ভিডিও দেখার জন্য মাসিক কিংবা বার্ষিক হিসাব অনুযায়ী একজন ইউজারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সাবস্ক্রিপশন ফি প্রদান করতে হয়। কারণ নেটফ্লিক্সে রয়েছে বেশকিছু ইউনিক বৈশিষ্ট্য। এখানে নতুন-পুরনো সব ধরনের মুভি এবং টিভি সিরিজ নিজের ইচ্ছেমতো উপভোগ করা যায় এবং এখানে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার হয় না।
নেটফ্লিক্স বিশ্বব্যাপী এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণগুলো হলো : ১. মূল বিষয়বস্তু : নেটফ্লিক্স তার উচ্চমানের মূল বিষয়বস্তুর বিস্তৃত লাইব্রেরির জন্য পরিচিত, যার মধ্যে ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস,’ ‘দ্য ক্রাউন’ এবং ‘দ্য উইচার’-এর মতো পুরস্কারবিজয়ী সিরিজ রয়েছে। তারা অসংখ্য মৌলিক চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্রও তৈরি করে। ২. বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য : নেটফ্লিক্স বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তু এবং জনসংখ্যার জন্য বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী সরবরাহ করে। আপনি শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সকল বয়সের জন্য সামগ্রী খুঁজে পেতে পারেন। ৩. গ্লোবাল রিচ : নেটফ্লিক্স ১৯০টিরও বেশি দেশে উপলব্ধ, যার অর্থ এটির একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক ক্যাটালগ রয়েছে। গ্রাহক যদি বিদেশী ভাষার সামগ্রীতে আগ্রহী হয় তবে এটি একটি সুবিধা হতে পারে। ৪. ব্যবহারকারীবান্ধব ইন্টারফেস : অনেক ব্যবহারকারী নেটফ্লিক্সের ব্যবহারকারী ইন্টারফেসকে স্বজ্ঞাত এবং নেভিগেট করা সহজ বলে মনে করেন। ৫. অফলাইন দেখা : নেটফ্লিক্স ব্যবহারকারীদের অফলাইন দেখার জন্য সামগ্রী ডাউনলোড করতে দেয়, যা সীমিত ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের জন্য সুবিধাজনক। ৬. বিনোদনের মাধ্যম : নেটফ্লিক্স বিনোদনের একটি বৃহত্তর মাধ্যম। এটি বিনোদন জগতের এক মহাসমুদ্র, যেখানে বিপুল পরিমাণে প্রোগ্রাম, সিনেমা, ওয়েব সিরিজ ইত্যাদি রয়েছে। ৭. স্ট্রিমিং পরিষেবা : নেটফ্লিক্স সিনেমা এবং টিভি শো স্ট্রিম করে। এটি থেকে বেছে নেওয়ার জন্য চলচ্চিত্র এবং টিভি শোগুলোর একটি লাইব্রেরি রয়েছে। ৮. ব্যবহার সুবিধা : যে কোনো ডিজিটাল ডিভাইস, যেমন কম্পিউটার, ফোন বা টিভিতে নেটফ্লিক্স উপভোগ করা যায়। ৯. পেইড সাবস্ক্রিপশন : নেটফ্লিক্স ব্যবহার করতে চাইলে গ্রাহককে পেইড সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে এক্সেস নিতে হয়।
এসব সুবিধার কারণে নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত নেটফ্লিক্সের ২৩২.৫ মিলিয়ন পেইড সাবস্ক্রাইবার ছিল। ২০২৪ সালের এখন পর্যন্ত এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮২.৭ মিলিয়ন, যার প্রায় ৭০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে। বেশিরভাগ নেটফ্লিক্স গ্রাহক ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা অঞ্চলের, যা নেটফ্লিক্সের মোট বিশ্বব্যাপী গ্রাহক সংখ্যার প্রায় ৯৬ মিলিয়ন। বাংলাদেশে যেহেতু নেটফ্লিক্সের দুই লাখেরও বেশি গ্রাহক আছে, তাই প্রতিবছর প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে গ্রাহকদের কথা বিবেচনা করে সম্প্রতি সরকার নেটফ্লিক্সকে বাংলাদেশে ক্যাশ সার্ভার বসানোর সুযোগ দিয়েছে। প্রায় সব ধরনের মুভি আর টিভি শো উপভোগ করা যায় নেটফ্লিক্সে। এমনকি নিজেদের প্রডিউস করা প্রোগ্রামগুলোও নেটফ্লিক্স প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক জনপ্রিয়। এগুলোকে নেটফ্লিক্স অরিজিনালস বলা হয়। এসব কারণেও নেটফ্লিক্স এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অন-ডিমান্ড ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস। তবে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মূল সার্ভার থেকে নেটফ্লিক্সের কন্টেন্ট দেখতে হয় এবং হাই রেজ্যুলেশনে কন্টেন্ট দেখতে প্রয়োজন হয় প্রায় ৮০ এমবিপিএস ইন্টারনেট। ফেসবুক কিংবা গুগলের গ্রাহক অনেক বেশি হলেও নেটফ্লিক্স ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস হওয়াতে অনেক বেশি ব্যান্ডউইডথ লাগে। মূলত বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে ব্যবহৃত ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের ১৫ ভাগই নেটফ্লিক্সের জন্য ব্যবহার হয়। এ কারণে গ্রাহককে নেটফ্লিক্স প্যাকেজ কিনতে হয় মাসিক ৩ থেকে ১২ ডলারের বিনিময়ে। সব মিলিয়ে প্রত্যেক গ্রাহকে গুনতে হচ্ছে কমবেশি হাজারখানেক টাকা।
ইন্টারনেট স্পিড সব সময়ই স্ট্রিমিং করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই নেটফ্লিক্স ২০১৬ সালে নিজেরাই একটি স্পিড টেস্ট করার জন্য ফ্রি ওয়েবসাইট তৈরি করেছে ব্যবহারকারীদের জন্য। ‘ফাস্ট ডট কম’ নামের এই ওয়েবসাইট গ্রাহককে বলে দেয় আইএসপির মাধ্যমে নেটফ্লিক্সের গতি এবং পারফরমন্স কেমন হয়। যা হোক, নেটফ্লিক্স প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিল ভিডিও রেন্টাল বা সিডি-ডিভিডি ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে, যা এখনো অব্যাহত আছে। তবে এটি তারা অনলাইনে আলাদা ওয়েবসাইট ব্যবহার করছে। অবশ্য নেটফ্লিক্স বর্তমানে মোবাইলের মাধ্যমে অনলাইন গেমিংয়ের দিকে বেশ দৃষ্টি দিয়েছে, অ্যাপের মাধ্যমে কমপক্ষে ৪০টিরও বেশি মোবাইল গেমস এখন খেলা যায়। বর্তমানে নেটফ্লিক্স সাবস্ক্রিপশনের সঙ্গে ফ্রিতেই এই গেম খেলা গেলেও ভবিষ্যতে একে সাবস্ক্রিপশনের আওতায় নিয়ে আসতে পারে। যদিও নেটফ্লিক্সের অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিশ্ববাজারে আছে আমাজনের প্রাইম-ভিডিও সার্ভিস। প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও নেটফ্লিক্স ও প্রাইম-ভিডিও আসলে পাশাপাশি একই সার্ভারে তাদের কনটেন্ট জমা রাখে। ২০১৬ সাল থেকে নেটফ্লিক্স তাদের অরিজিনাল সকল কনটেন্ট জমা রাখতে ব্যবহার করছে আমাজনের এই সেবা।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়