শিশুরা একটি জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাদের শৈশব নানা সমস্যায় ভরপুর। শিশুশ্রম এবং শিশু নির্যাতন এমন দুটি মারাত্মক সমস্যা যা শুধু তাদের শৈশব কেড়ে নেয় না, বরং তাদের ভবিষ্যৎকেও অন্ধকারে ঠেলে দেয়। বিশ্বব্যাপী, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, শিশুশ্রম এবং শিশু নির্যাতন আজও একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত, কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অনেক শিশুই এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিশুশ্রম এবং শিশু নির্যাতন তাদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের উপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শিশুশ্রম হলো একটি সামাজিক অপরাধ, যেখানে শিশুদের শারীরিক বা মানসিক কাজে নিযুক্ত করা হয় যা তাদের শৈশবকে হরণ করে এবং তাদের ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে বিপদে ফেলে। বিশ্বের অনেক দেশে দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব এবং পরিবারের অক্ষমতা শিশুশ্রমের প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে। বতর্মান সময়ে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করলেও গত ১০ বছরে দেশে শিশুশ্রম কমেনি বরং বেড়েছে। এ সময়ে দেশে প্রায় এক লাখ শিশুশ্রমিক বেড়েছে। সর্বশেষ হিসাবে, দেশে এখন ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন শিশুশ্রমিক আছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। এছাড়া বর্তমান শিশুশ্রমিকদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তবে ১০ বছরের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দুই লাখের মতো কমেছে।
বিবিএস গত বছরের ৫ ফেব্রæয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত তিন মাসজুড়ে দেশের ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ওপর এই জরিপ করা হয় জরিপে ৩০ হাজার ৮১৬ পরিবার অংশ নেয়। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী —
দেশে মোট শিশুর সংখ্যা ৪ কোটি
* শিশুশ্রমিকদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে।
* ২০ লাখ ১০ হাজার শিশুশ্রমিক পারিশ্রমিক পায় না।
* যারা পারিশ্রমিক পায় তাদের গড় আয় মাসে ৬৬৭৫ টাকা।
শিশুশ্রম যেন দারিদ্র্য ও অবহেলার ফল
শিশুশ্রম বলতে বোঝানো হয় শিশুদের এমন কাজে নিযুক্ত করা যা তাদের পড়াশোনা, শৈশব এবং মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করে। সাধারণত অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক বৈষম্য শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করার পেছনে প্রধান কারণ। যদিও অনেক দেশেই শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে, তবুও দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানের উপার্জন ক্ষমতা দেখে তাদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।
শিশুশ্রমের ফলে শিশুরা দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিশুরা খেলাধুলা বা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং ভবিষ্যতে তাদের জীবনযাত্রার মান কমে যায়। একদিকে, এটি সমাজে অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের চক্র সৃষ্টি করে, অন্যদিকে এটি শিশুর প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি গুরুতর দৃষ্টান্ত।
শিশু নির্যাতন : শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি
শিশু নির্যাতন হলো এমন এক পরিস্থিতি যেখানে শিশুদের প্রতি শারীরিক, মানসিক বা যৌন অত্যাচার করা হয়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নের জন্য বিপজ্জনক। শিশুরা তাদের পিতামাতার কাছ থেকে স্নেহ, ভালোবাসা ও সুরক্ষা আশা করে, কিন্তু নির্যাতনের শিকার হলে তারা এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে।
শিশু নির্যাতনের বিভিন্ন ধরণ
* শারীরিক নির্যাতনঃ শিশুদের মারধোর, আঘাত বা শারীরিক কষ্ট দেওয়া।
* মানসিক নির্যাতনঃ শিশুকে মানসিকভাবে আঘাত দেওয়া, যেমন তাদের অপমান করা, অবহেলা করা, ভয় দেখানো বা অশান্ত পরিবেশে রাখা।
* যৌন নির্যাতনঃ শিশুকে যৌন নিগ্রহ বা শোষণ করা, যা তাদের ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
শিশু নির্যাতন কেবল তাদের শরীরের ক্ষতি করে না, বরং তাদের আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক স্থিতিশীলতাও ধ্বংস করে দেয়। যে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হয়, তারা অনেক সময় সমাজে একটি নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠে, জীবনে তাদের সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতনের সম্পর্ক
শিশুশ্রম এবং শিশু নির্যাতনের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। শিশুদের কাজে লাগানোর ফলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপীড়িত হয়, যা এক প্রকার নির্যাতন হিসেবে গণ্য হতে পারে। শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুরা প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হয়, বিশেষত যখন তাদের কাজ অত্যধিক পরিশ্রমী বা শোষণমূলক হয়। তাদের খাওয়ার বা বিশ্রামের সুযোগ কম থাকে, তারা অধিকাংশ সময়ই উপেক্ষিত থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রেই শারীরিক বা মানসিকভাবে অপমানিত হতে হয়। এই সমস্ত পরিস্থিতি শিশুদের জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দেয় এবং তাদের ভবিষ্যতের সুযোগ সংকুচিত করে।
শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতন রোধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি একটি বৃহৎ সামাজিক দায়িত্ব। এই দুটি সমস্যা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন,যাতে শিশুদের নিরাপত্তা, অধিকার এবং সুস্থতা নিশ্চিত করা যায়।
শিশুশ্রম রোধের উপায়
শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি: শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ হলো অল্প বয়সে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া। তাই, সরকার এবং সমাজের উচিত শিশুদের জন্য সুলভ ও বাধাহীন শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ফ্রি এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে, বিশেষত দরিদ্র এলাকায়।
দারিদ্র্য দূরীকরণ: শিশুশ্রমের প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য। দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের কাজে নিযুক্ত করে থাকে। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প চালু করা উচিত। সরকারি এবং এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা এবং মাইক্রোফিন্যান্স সুবিধা দিতে পারে।
আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধি: শিশুশ্রম রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে শিশুদের অধিকার সম্পর্কেও পরিবার এবং সমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিশুদের কাজের পরিবেশে নজরদারি বৃদ্ধি এবং শিশুশ্রমের সাথে জড়িত সাথে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া উচিত।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মনিটরিং: বিভিন্ন শিল্প-কারখানা এবং অন্যান্য কাজের জায়গায় শিশুদের উপস্থিতি খতিয়ে দেখতে হবে। পাড়া-মহল্লায় কর্মস্থলে শিশুদের কাজের অবস্থা নজরদারি করা যেতে পারে।
পরিবারে সমর্থন প্রদান: পরিবারগুলোকে শিশুশ্রম থেকে মুক্ত রাখার জন্য তাদের প্রাথমিক চাহিদা মেটাতে সাহায্য করা উচিত, যাতে শিশুরা কর্মক্ষেত্রে যেতে বাধ্য না হয়।
শিশু নির্যাতন রোধের উপায়
আইনগত পদক্ষেপ ও কঠোর শাস্তি: শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। নির্যাতনকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিশেষ আইন প্রণয়ন এবং দ্রæত বিচার নিশ্চিত করা।
শিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার বিষয়ে শিক্ষা: শিশুদের তাদের অধিকার ও সুরক্ষা বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তারা যেন জানে তাদের প্রতি কোন ধরনের আচরণ অগ্রহণযোগ্য। স্কুল এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের জন্য সুরক্ষা বিষয়ক শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।
পিতামাতার সচেতনতা বৃদ্ধি: শিশুশিক্ষা ও পরিবারের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে তাদের সন্তানের নিরাপত্তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। পিতামাতাদের জন্য প্যারেন্টিং শিক্ষা বা কর্মশালা আয়োজন করতে হবে, যাতে তারা ভালো আচরণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতন হয়।
শিশুদের সুরক্ষা কমিটি গঠন: প্রতিটি স্কুল, কমিউনিটি বা সমাজে শিশুদের শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যএকটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটি শিশুদের সুরক্ষা, নির্যাতন ও প্রতিরোধ ও আইন শৃঙ্খলা বিষয়ে নজর রাখবে।
পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ: শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঠিক প্রশিক্ষণ জরুরি যাতে তারা নির্যাতনকারী এবং ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর মধ্যে সঠিক বিচার পরিচালনা করতে পারে।
সামাজিক দায়িত্ব
সমাজিক প্রচারণা চালিয়ে শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতন রোধের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়া, সেমিনার, ওর্য়াকশপের মাধ্যমে মানুষকে এসব বিষয়ে সচেতন করতে হবে। বিভিন্ন এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শিশুশ্রম ও নির্যাতন রোধে কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে পারে। তারা প্রচারণা চালাতে, সহয়তা প্রদান করতে এবং আইনি সাহায্য দিতে পারে। একে অপরকে সাহায্য করার জন্য পারিবারিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা জরুরি। যদি কেউ কোনো শিশুর প্রতি নির্যাতন বা শোষণ দেখে, তারা যেন তা জানাতে সাহস পায়। শিশুশ্রম এবং শিশু নির্যাতন রোধে সমাজের প্রতিটি স্তরের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কঠোর আইন, সামাজিক সচেতনতা, পরিবার এবং স্কুলের সহয়তায় শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতন একটি সমাজের স্বাস্থ্য, উন্নয়ন এবং নৈতিকতার জন্য বড় হুমকি। সকলকে একযোগভাবে কাজ করতে হবে যেন ভবিষ্যতের প্রজন্ম নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং সুষ্ঠু পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে। শিশুদের অধিকার রক্ষা করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
শিক্ষার্থী , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়