দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা শহরের ময়ূর নদীর পাড় ঘেঁষে অবস্থিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২৫ নভেম্বর, ১৯৯১ সালে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষার গুণগতমান ও গবেষণার প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতিমুক্ত পরিবেশ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বতন্ত্র করেছে। এই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের একাডেমিক এবং গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত। বাংলাদেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে, সেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখেছে। রাজনীতিমুক্ত এই নীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের পছন্দের প্রথম সারিতে স্থান করে নেয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে পড়াশোনা করার সুযোগ তৈরি করে। ফলস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা সেশনজট থেকে মুক্ত থেকে সময়মতো তাদের পড়াশোনা শেষ করতে পারেন, যা দেশের অন্যান্য অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যটি বিভিন্ন পটভূমির শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করেছে এবং এক প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকেন। কারণ তারা জানেন যে, এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হবে না।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে সাতটি স্কুল এবং ২৯টি ডিসিপ্লিনে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রাম অফার করে। এসব প্রোগ্রাম বিশ্বের বর্তমান চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রয়োজনীয়তাগুলোকে সামনে রেখে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ফরেস্ট্রি ও উড টেকনোলজি, ফিশারিজ, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এবং আরবান প্ল্যানিংয়ের মতো বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এগুলো এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাশাপাশি ব্যবসায় প্রশাসন, সামাজিক বিজ্ঞান, কলা, আইন, ফাইন আর্টস প্রভৃতি বিষয়গুলোও সমানভাবে শিক্ষা ও গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে।
এই প্রোগ্রামগুলো শুধু আঞ্চলিক সমস্যাগুলোর অধ্যয়ন ও সমাধানকেই ফোকাস করে না, বরং জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, যা বাস্তব সমস্যার সমাধান এবং জ্ঞানের প্রসারে সহায়ক। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি সুন্দরবনের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ার কারণে পরিবেশবিজ্ঞান, জীববৈচিত্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণার এক বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই অঞ্চল সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন, যা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নীতিমালা প্রণয়নে ভূমিকা রাখছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক অর্জন করেছে। যেমন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিতভাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অবস্থান করছে। বিগত বছরগুলোতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে এটি বরাবরই প্রথম সারিতে অবস্থান করেছে। এখানকার শিক্ষকরা ও গবেষকগণ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুদান পেয়ে চলেছেন এবং স্বীকৃত জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ করে চলেছেন, যা এই প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষতার স্মারক বহন করে। তাছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (ঝউএ)-এর বিভিন্ন প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়টির সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর গ্র্যাজুয়েটরা বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন এবং আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষতা অর্জন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির সামাজিক দায়বদ্ধতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক নৈতিক দায়িত্ববোধ তৈরি করে। এর অনেক প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীই সমাজ উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এক অনন্য উদাহরণ। এর রাজনীতি-মুক্ত পরিবেশ, বিশেষায়িত একাডেমিক ডিসিপ্লিন এবং গবেষণায় অবদানের মাধ্যমে এটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং জাতীয় পর্যায়ে এক বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশের উন্নয়নের পথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। একে শক্তিশালী ও কার্যকরী করতে সরকার ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, যা শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক : পিএইচডি গবেষক ও একাডেমিক, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া
ও সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়