সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলন দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই আন্দোলন কেবল বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই নয়, বরং দেশের ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বিশেষ করে নারীর উপস্থিতি এবং তাদের দৃঢ় ভূমিকা সমাজে নারীর জন্য প্রকৃত সমতা ও পরিবর্তনের আশাকে আরও উজ্জ্বল করেছে। মিছিলে নারীর উপস্থিতি শুধু তাদের সংখ্যায় সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তারা নেতৃত্ব দিয়েছে, প্রতিবাদে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছেÑ এই আশায় যে ভবিষ্যতে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের অধিকার সুরক্ষিত হবে।
তবে, দুঃখজনকভাবে আন্দোলনের উত্তেজনা ও সমাপ্তির পর যখন সরকার গঠন ও তৎপরবর্তী বিভিন্ন সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হলো, তখন নারীর উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগে নারীর অংশগ্রহণের এই অভাব শুধু হতাশাজনক নয়, বরং এটি একটি বড় প্রশ্ন উত্থাপন করে : আন্দোলনে নারীরা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা কি সংস্কারের কণ্ঠ হিসেবে মূল্যায়িত হলো? আন্দোলনের সময় যেসব নারী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের কণ্ঠস্বর যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হলো কিনাÑ এই প্রশ্নটি আমাদের সামনে আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীরা যদি সংস্কার প্রক্রিয়ায় সঠিকভাবে স্থান না পান, তবে বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং সমাজে স্থায়ী সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তা কতটা সফল হবে?
আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে নারীদের সক্রিয় ও সাহসী ভূমিকা আমাদের দেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তারা কেবল মিছিলের সামনের সারিতেই দাঁড়াননি; বরং নেতৃত্বের আসনে থেকেও আন্দোলনকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এই সময়ে নারীরা বিভিন্ন স্লোগান তুলে ধরেছিলেন, যাতে কেবল তাদের নিজেদের অধিকারের আওয়াজই নয়, সর্বজনীন মানবাধিকারের দাবি ছিল প্রতিফলিত। নারীরা মিছিল-সমাবেশে সামনের দিকে অবস্থান করে পুরুষ আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার ও সমূহ নির্যাতন থেকে পরোক্ষভাবে সুরক্ষা দিয়েছেন। এ ছাড়া, নারীরা বিভিন্ন আলোচনা সভায় প্রভাবশালী বক্তব্য দিয়েছেন, যা আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে আরও পরিষ্কার করেছে এবং প্রতিবাদের ভাষাকে শক্তিশালী করেছে।
নারীরা আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ, সংহতি রক্ষা এবং প্রতিবাদী কর্মসূচিগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের এই অংশগ্রহণ কেবল নারীর সমান অধিকারের দাবিকে তুলে ধরেনি; বরং দেশের প্রতিটি মানুষকে সমান মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের অধিকার দিতে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার যে আকাক্সক্ষা তা স্পষ্ট করেছে। এই দৃঢ় পদক্ষেপ নারীর জন্য স্বাধীনতা ও অধিকারের আন্দোলনকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং প্রগতিশীল, মানবিক বাংলাদেশ গঠনে এক বড় আশার প্রতীক হয়ে উঠেছে। নারী-পুরুষের সমান অধিকারের পথে দেশের এগিয়ে চলার এই প্রতিশ্রুতি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করছে।
নারীদের মিছিলে অংশগ্রহণ কেবল সংখ্যাগত উপস্থিতি নয়; বরং তা আন্দোলনের নৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিকে দৃঢ় করেছে, যা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অংশগ্রহণ নারীদের কণ্ঠকে তুলে ধরেছে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের অধিকারের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে নারীর অবদানের গুরুত্বকে প্রমাণ করেছে। নারীদের উপস্থিতি আন্দোলনের একটি শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর প্রতিনিধিত্ব অপরিহার্য এবং বৈষম্য দূরীকরণের এই সংগ্রামে তারা কেবল সহযোগী নয়, বরং নেতৃত্বের আসনে থাকা অপরিহার্য অংশীদার।
বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে নারীর শামিল হওয়া ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজনীয় এবং আজকের সমসাময়িক বাস্তবতায় তা আরও অপরিহার্য। সমাজে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করতে চাইলে কেবল একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নয়, বরং সমস্ত লিঙ্গের প্রতিনিধিত্বে সমাজের প্রতিটি অংশের সমর্থন প্রয়োজন। নারীরা এ আন্দোলনে তাদের কণ্ঠ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে যোগ দিয়ে বৈষম্য দূরীকরণ এবং সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে একটি উদাহরণ তৈরি করেছেন। বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে নারীর শামিল হওয়া প্রমাণ করে যে, এই আন্দোলন কেবল পুরুষদের নয়; বরং সবার জন্য। তাদের ভূমিকা যেন এক সুষম সমাজের প্রতিচ্ছবি, যেখানে পুরুষ ও নারী উভয়েই সমান মর্যাদার অধিকারী।
নারীদের এই অংশগ্রহণ শুধু বর্তমান আন্দোলনের জন্য নয়; বরং ভবিষ্যতের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাদের ভূমিকা নতুন প্রজন্মের নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে, যাতে পরবর্তীতে তারা আরও সমান অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। সমাজে সত্যিকার অর্থে বৈষম্যহীন পরিবর্তন আনতে নারীর অংশগ্রহণকে তাই কেবল স্বীকৃতি দেওয়া নয়, বরং সমর্থন ও প্রয়োজনীয়তার দিক থেকেও গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য।
আন্দোলনের পর সরকারের পক্ষ থেকে যখন বিভিন্ন সংস্কারমূলক উদ্যোগ নেওয়া শুরু হলো, তখন নারীর উপস্থিতি সেই প্রক্রিয়া থেকে অনেকটা অদৃশ্য হয়ে গেল। এই নীতিনির্ধারণ ও কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় নারীর অবহেলার বিষয়টি স্পষ্টভাবে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো এবং প্রচলিত পক্ষপাতের প্রতিফলন। সমাজে নারীদের অংশগ্রহণ স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও, সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে তাদের অন্তর্ভুক্তির প্রতি যে অনীহা রয়েছে তা কয়েকটি মূল কারণ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাত অন্যতম। প্রায়শই দেখা যায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হয় না। এর কারণ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতার ওপর অবিশ্বাস প্রকাশ করে। নারীরা আন্দোলনে সাহসিকতার পরিচয় দিলেও, অনেক ক্ষেত্রেই তারা যখন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আসতে চান, তখন তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এই পক্ষপাতের কারণে নারীর ভূমিকা আন্দোলন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে এবং সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের কণ্ঠস্বর আগের মতো শ্রুত নয়।
সামাজিক মনোভাব ও লিঙ্গ বৈষম্যকে এজন্য দায়ী করা হয়; কারণ, সমাজে নারীর ভূমিকা এখনো মূলত গৃহস্থালিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। আন্দোলনের সময় নারীদের নেতৃত্ব এবং সাহসিকতা প্রশংসিত হলেও, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাদের গ্রহণ করার মতো মানসিকতা এখনো গড়ে ওঠেনি। সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা নারীর ক্ষমতায়নকে প্রকৃত অর্থে সমর্থন করে না, যা সংস্কারের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানে মধ্যেও প্রয়োজনীয় সংবেদনশীলতা এবং নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার মতো কাঠামো প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা লক্ষ্য করা যায়। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কথা বলা হলেও, এই লক্ষ্য পূরণে কার্যকর নীতি এবং স্পষ্ট কাঠামো প্রণয়নের অভাবে, নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তি বাধাগ্রস্ত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালার অভাবে সংস্কার প্রক্রিয়া নারীবান্ধব হয়ে ওঠে না, ফলে আন্দোলনের সময় অর্জিত সমতা এবং ন্যায়বিচারের আকাক্সক্ষা অনেকাংশে অপূর্ণ থেকে যায়।
এ ধরনের অবহেলা কেবল আন্দোলনের মূল লক্ষ্যকে দুর্বল করে দেয় না, বরং সমাজের বৈষম্যহীন পরিবর্তনের আকাক্সক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। নারীর সমান অংশগ্রহণের অভাব পূরণ না হলে, প্রকৃত সংস্কারের লক্ষ্য অর্জিত হওয়া কঠিন।
একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য নারীর অংশগ্রহণ একান্ত জরুরি। নারীর অনুপস্থিতিতে যে কোনো সংস্কার কার্যত সমাজের বৈচিত্র্য এবং পূর্ণতা প্রতিফলিত করতে ব্যর্থ হয়। সংস্কারমূলক উদ্যোগে নারীর ভূমিকা ও প্রতিনিধিত্ব ছাড়া গৃহীত নীতি বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যকর ফলাফলের আশা করা যায় না, কারণ এটি সমাজের অর্ধেক অংশের অভিজ্ঞতা ও চাহিদাকে উপেক্ষা করে চলে। বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে নারীদের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া প্রকৃত পরিবর্তন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, কারণ সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের অভিজ্ঞতা ও চাহিদা থেকে প্রাপ্ত অন্তর্দৃষ্টি একটি সুষম ও গ্রহণযোগ্য সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
নারীরা যখন সংস্কার প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করবেন, তখনই লিঙ্গবৈষম্য মোকাবিলার সঠিক উপায় নির্ধারণ সম্ভব হবে। নারীদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা সমস্যা ও সমাধানগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হয়। বিশেষ করে যখন বৈষম্য নিরসনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়, তখন নারীর অন্তর্ভুক্তি এই ধরনের নীতির কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
নারীরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে যে দৃঢ়তা, সাহস এবং নেতৃত্ব দেখিয়েছেন তা সমাজে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। তাদের অগ্রণী ভূমিকা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, সমতা এবং ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে নারীর অংশগ্রহণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই পরিবর্তনের চেতনা যেন কেবল মিছিলে সীমাবদ্ধ না থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের কণ্ঠ যেন নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় শ্রুত হয়, মূল্যায়িত হয় এবং যোগ্যতমদের অন্তর্ভুক্তির ভিত্তিতে সংস্কার প্রক্রিয়াসহ সকল ক্ষেত্রে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। নারীরা যে পরিবর্তনের সূচনা করেছেন সেই পরিবর্তন যেন নীতিতে এবং বাস্তবায়নে প্রতিফলিত হয়। এতেই সমাজে সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।
লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়