বর্ধিঞ্চু জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই। মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রেখে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে কৃষি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা গেলে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে বৈ কমবে না। ফসলের নিবিড়তা বাড়াতে সব জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরের বিষয়টি অনেক ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। জমির উর্বরতা, জমির শ্রেণিবিভাগ, জমির ধরন এসব বিষয়ের ওপর ফসল আবাদ নির্ভর করে। প্লাবন নিম্নভূমি, উঁচু ভূমি, বন্যা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, খরা, অতিবৃষ্টি, সেচের অভাব এসব প্রতিবন্ধকতার দরুন অনেকক্ষেত্রে সব কৃষি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা কঠিন হয়ে পড়ে। খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় আনলে এসব বাধা বা প্রতিবন্ধকতা দূর করে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা সময়ের দাবি। এর জন্য দরকার কৃষি-পরিবেশ অঞ্চলভিত্তিক বাস্তায়নযোগ্য সমন্বিত কৃষি পরিকল্পনা।
সম্প্রতি ১৪ নভেম্বর ২০২৪ খ্রি. উপদেষ্টা, কৃষি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বরিশাল এ কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তরসমূহের এক মতবিনিময় সভায় ‘দেশের এক ফসলি ও দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করার ওপর জোর তাগিদ দেন। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এহেন নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। মতবিনিময় সভায় তিনি আরও বলেন, বরিশাল এক সময় শস্যভাণ্ডার নামে খ্যাত ছিল, তা এখন উত্তরবঙ্গে চলে গেছে। বরিশালকে পুনরায় শস্যভাণ্ডারে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের জোর প্রচেষ্টা চালাতে নির্দেশনা প্রদান করেন।’ খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সকল কৃষি জমিকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যবহার করা অতীব জরুরি। তার জন্য কার্যকর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। জমির বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহার বাড়াতে পারলে জমির অর্থনৈতিক ব্যবহার সুনিশ্চিত হয় এবং লাভজনক কৃষিতে রূপান্তর সহজতর হয়। দেশের কৃষি উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০২৩ (পৃষ্ঠা ৪৩০ ও ৪৩২) এর তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ সালে দেশে এক ফসলি জমির পরিমাণ ৫০৮৪ হাজার একর, দুই ফসলি জমি ১০১৪৯ হাজার একর এবং তিন ফসলি জমি ৪৫৯২ হাজার একর। মোট ফসলি জমির পরিমাণ ৩৯৩৫৮ হাজার একর, চলতি পতিত জমি ১২০৬ হাজার একর এবং নিট ফসলি জমি ১৯৮৭৫ হাজার একর। উক্ত বছরে দেশের ফসলের গড় নিবিড়তা ১৯৮%। এ নিবিড়তা আরও বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। এক ফসলি জমিকে দুই ফসলি ও দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা গেলে শস্য নিবিড়তা আরও বাড়বে এবং সে সঙ্গে সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদন বাড়বে। দেশের মোট ফসলি জমির সিংহভাগই ধানভিত্তিক ফসলধারার জমি। এলাকাভিত্তিক অলাভজনক ফসলধারা বা শস্য পর্যায় চিহ্নিত করে সেখানে লাভজনক ফসলধারা সন্নিবেশ করা গেলে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে এবং কৃষক লাভবান হবে। দেশে প্রায় ৩৬০ ধরনের শস্য পর্যায় বিদ্যমান রয়েছে। তার মধ্যে কোনো কোনো ফসলধারা এক ফসলি, কোনোটা আবার দুই ফসলি, তিন ফসলি ও চার ফসলি জমিও রয়েছে।
এক ফসলি ও দুই ফসলি জমির বা শস্য পর্যায়ের জমিগুলোর বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে টার্গেটভিত্তিতে এক ফসলিকে দুই ফসলি এবং দুই ফসলিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করার জোর প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে। তার জন্য এক ফসলি ও দুই ফসলি জমির প্রতিবন্ধকতা বা সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে তা দূরীকরণের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এক ফসলি ও দুই ফসলি জমির বিদ্যমান শস্য পর্যায় বিশ্লেষণ করে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে ক্রমান্বয়ে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর সম্ভব। যেমনÑ কুমিল্লার মেঘনা ও তিতাস এলাকায় সরিষা-পতিত-বোনা আমন একটি প্রচলিত শস্য পর্যায়। এর মধ্যে পতিত সময়কালীন বারি তিল-৪ বা বারি তিল-৬ (কালোতিল) অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সহজে দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা যায়। এ বিষয়টির ওপর গবেষণা করে উন্নত ফসলধারার ওপর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, কুমিল্লা। এ রকম আরও বহু উন্নত ফসলধারা দেশের বিভিন্ন জেলায় সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে যা সঠিকভাবে মাঠে বিস্তার ঘটাতে পারলে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা অনেকটা সহজ হবে। তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করতে হলে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার যাতে মাটির স্বাস্থ্যহানি না ঘটে। তার জন্য জমিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার প্রয়োগ করা দরকার। তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা গেলে শস্য বহুমুখীকরণ যেমন বাড়বে, তেমনি উচ্চ ফলনশীল জাতের অন্তর্ভুক্তির কারণে ফসলের উৎপাদনশীলতা ও নিবিড়তা বাড়বে।
এক ফসলি জমিকে দুই ফসলি এবং দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করতে এলাকাভিত্তিক ক্রপ জোনিংকে কাজে লাগাতে হবে এবং উপযুক্ত প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে হবে। কৃষকদের মানসম্মত বীজ, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সহজপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এলাকাভিত্তিক এক ফসলি, দুই ফসলি ও অনাবাদি জমির উপযুক্ত সুনির্দিষ্ট ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি বিষয়ে কৃষকদের দক্ষ করে তোলা; যে এলাকায় যে ফসল ভালো হবে, তার বাণিজ্যিক চাষাবাদে উৎসাহ ও প্রণোদনা/ উপকরণ সহায়তা প্রদান; বাণিজ্যিক চাষাবাদে আগ্রহী কৃষকদের ব্যাংক লোন প্রদান এবং উক্ত লোন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করা; লাভজনক শস্য পর্যায় চিহ্নিতকরণ ও বিস্তার ঘটানো; এলাকাভিত্তিক লাভজনক নতুন শস্য পর্যায় বিস্তার ঘটানো; এলাকার চাহিদামাফিক ফসল উৎপাদন করা; জলবায়ু সহনশীল ফসলের আরও জাত উদ্ভাবন এবং উদ্ভাবিত জাতসমূহ দ্রুত কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছানো; সেচের ব্যবস্থা করার জন্য খাল খনন করা, নিচু জমির পানি নিকাশের জন্য ড্রেনের বা স্লুইচ গেট নির্মাণ করা; জলাবদ্ধতা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন ও বিস্তার ঘটানো একান্ত দরকার। নিচু জমিতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ফসলের আবাদ করা; উঁচু এবং ঢালু বা টিলা জাতীয় ভূমিতে কলা, বরই, পেয়ারা, আম, ড্রাগন ফল, মাল্টাসহ উপযুক্ত ফলের আবাদ করা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সবজির আন্তঃফসল চাষ করা গেলে কৃষকের আয় বাড়বে। জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় শস্য বহুমুখীকরণ; শস্যবিমা চালু করা এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আরও বিস্তার করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিনাসহ দেশের অন্যান্য গবেষণার বহু কৃষি প্রযুক্তি রয়েছে। ব্রি’র ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ব্রি ধান৮৫ কিছুটা জলাবদ্ধতা সহনশীল হওয়ায় এ জাতটি আউশ মৌসুমে অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকাতে বিশেষত কুমিল্লা অঞ্চলসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত। ব্রি ধান২৭ বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে রোপা আউশ মৌসুমে চাষাবাদযোগ্য। ব্রি ধান ৯১ জলি আমন ধানের জাত ও অগভীর পানিতে চাষের উপযোগী। বৃষ্টিনির্ভর নিম্নভূমি অঞ্চলের জন্য বিআর১০, ব্রি ধান৩০ এবং ব্রি ধান৩১ উদ্ভাবন করা হয়েছে। তিনটি বন্যা সহনশীল ধানের জাত যথা ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২ এবং ব্রি ধান৭৯ উদ্ভাবন করা হয়েছে যা দুই-তিন সপ্তাহ পর্যন্ত বন্যা সহনশীল। চারটি খরা সহনশীল আমন ধানের জাত যথা ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭, ব্রি ধান৬৬, ব্রি ধান৭১ উদ্ভাবন করা হয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশের খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য খুবই উপযোগী। লবণাক্ততা সহনশীল ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৪ এবং ব্রি ধান৭৩ এই জাতগুলো আমন মৌসুমে প্রজনন পর্যায়ে ৮ ডিএস/মি. লবণাক্ততা সহনশীল। ব্রি ধান৭৮ আমন মৌসুমের উপযোগী বন্যা ও লবণাক্ততা সহনশীল ধানের জাত। কৃষিপরিবেশ অঞ্চল ও জমির শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী এসব ধানের জাতের বিস্তার ঘটিয়ে উৎপাদনশীলতা ও ফসলের নিবিড়তা বাড়ানো সম্ভব।
সর্বোপরি ইউনিয়ন/উপজেলা পর্যায়ে অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনা, এক ফসলিকে দুই ফসলি ও দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলিতে আনা সফল কৃষক ও কৃষি কর্মীদের পুরস্কৃত করা গেলে তাদের উৎসাহ বহুগুণ বেড়ে যাবে। উপরোক্ত কাজগুলো সঠিকভাবে করতে দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর কার্যকর প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। সম্মিলিত সবার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে, ফসলের নিবিড়তা বাড়বে এবং সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বারি, কুমিল্লা।
সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, এফএও, জাতিসংঘ।
ঔধসধষঁফফরহ১৯৭১@ুধযড়ড়.পড়স