বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা এবং নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য একটি মৌলিক আইন বা সংবিধান প্রয়োজনীয়। সংবিধান শুধু একটি আইনগ্রন্থ নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের অস্থিরতা বা যে কোন সংকটের মুহূর্তে জাতিকে পথনির্দেশ দেয়। তাই সংবিধান পড়া এবং তার গুরুত্ব উপলব্ধি করা আমাদের সকলের জন্যই জরুরি। এটি একটি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি তৈরি করে এবং দেশের উন্নতি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। সংবিধান শব্দটি মূলত ল্যাটিন শব্দ ‘পড়হংঃরঃঁঃরড়’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো ‘সংরক্ষণ করা’ বা ‘নির্মাণ করা’। এটি একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন যা সরকারের কাঠামো, শাসনব্যবস্থা, নাগরিকদের অধিকার এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্ধারণ করে। একটি দেশের সংবিধান তার আইনি, সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করে। সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করে। এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করে বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, শিক্ষা অধিকার, প্রোপার্টি রাইট, ভোটের অধিকার এবং সমঅধিকার। নাগরিকরা যদি তাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত থাকে, তবে তারা অযাচিত রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংবিধান গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে এবং সংবিধান এই ক্ষমতাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করে। জনগণের মতামত এবং ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় এবং সংবিধান এ বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশনা দেয়।
সংবিধান একটি আইনগত কাঠামো তৈরি করে যার মাধ্যমে সকল নাগরিক সমানভাবে আইনের অধীনে আসে। এটি নাগরিকদের একটি নির্দিষ্ট নিরাপত্তা দেয়, যাতে তাদের অধিকার বা সম্পত্তির প্রতি অন্যায্য হস্তক্ষেপ না করা যায়। সংবিধান জানা থাকলে মানুষ তাদের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারে এবং একে অপরকে তাদের অধিকার রক্ষায় সাহায্য করতে পারে। সংবিধান রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার কাঠামো নির্ধারণ করে, যাতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমনÑ নির্বাহী, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ সঠিকভাবে তাদের কাজ করতে পারে। এই বিভাজন রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখে এবং একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত ক্ষমতা লাভকে বাধাগ্রস্ত করে। এটি রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে এক সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে। সংবিধান দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য একটি নীতি প্রণয়ন করে। এটি দেশকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করতে সহায়তা করে, যাতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়। উন্নত রাষ্ট্র গঠনে সংবিধান নাগরিকদের দায়িত্ব, কর্তব্য এবং সরকারের উদ্দেশ্যগুলো পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দেয়।
সংবিধান পড়া নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ এর মাধ্যমে তারা তাদের অধিকার এবং কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারে। যদি নাগরিকরা জানেন যে, তাদের অধিকার লঙ্ঘন হলে কিভাবে তারা তা রক্ষার জন্য আদালতের কাছে যেতে পারবেন, তাহলে তারা অধিকারের প্রতি আরো সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল হবে। এছাড়া, সংবিধান পড়ার মাধ্যমে একটি দেশের জনগণ শাসনব্যবস্থার ধরন, সরকারের ক্ষমতার সীমা, এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদা সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। এটি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে সাহায্য করে, যেখানে জনগণের অধিকারের প্রতি সম্মান রাখা হয়।
২৪Ñএর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সবথেকে বেশি আলোচিত বিষয় ‘সংবিধান সংস্কার’ । বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে সংবিধানকে পৌছে দেয়া চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতা থেকে আজ পর্যন্ত সংবিধান বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বা ধারণা নেই। ফলে বিভিন্ন সরকার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৷ তাই সংস্কার করার পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের কাছে সংবিধানের জ্ঞান পৌঁছে দেয়া আবশ্যক। তবেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সচেতনতা বৃদ্ধি সম্ভব। সংবিধান পড়া একটি নাগরিকের সাংবিধানিক দায়িত্বের অংশ এবং এটি দেশের ভবিষ্যতের প্রতি একটি সক্রিয় অবদান। যে কোনো উন্নত সমাজ গঠন করতে হলে, নাগরিকদের মধ্যে সংবিধান সম্পর্কে গভীর সচেতনতা ও বুঝ থাকা প্রয়োজন। তাই, প্রতিটি নাগরিকের জন্য সংবিধান পড়া শুধু আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং একটি শক্তিশালী, সুশাসিত এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য অপরিহার্য।
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ