সংস্কৃতি একটি জাতির পরিচয় বহন করে। পৃথিবীর বুকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে স্বমহিমায়। দেশকে করে সম্মানিত, দেশের মানুষকে করে গর্বিত। বাঙালি হিসেবে আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এ দেশের জন্মের পেছনে রয়েছে অগনিত সব স্বপ্ন আর স্মৃতির ছোঁয়া। এই স্বপ্ন একটা সুস্থ-সুন্দর সমাজের, বৈষম্যহীন ও অসা¤প্রদায়িক দেশের। আমাদের স্মৃতির মধ্যে ছিলো অতীতের সংগ্রামী চেতনা, গোলা ভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, নদীতে হাটুজল। ছিলো বাউল, জারি, সারি, ঘাটু, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া গানসহ আরোও কত কী। এসব কিছুই আমাদের সংস্কৃতির অংশ যেগুলো নিবিড়ভাবে মিশে আছে আমাদের স্মৃতিতে। এজন্যই হয়তো ডি.এল রায় বলেছিলেন ‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।’
বর্তমানে আমাদের সমাজের দিকে একটু দৃষ্টি দিলেই দেখা যায় আমরা কিভাবে নিজের অস্তিত্ব, নিজের সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে অন্যের সংস্কৃতি চর্চায় মশগুল হয়ে আছি। যেন একবারের জন্যও নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতির কথা ভাবছি না। বিষয়টা একজন বাঙালি হিসেবে খুবই হতাশাজনক। বর্তমানে পশ্চিমা সংস্কৃতির অপচর্চা এমন পর্যায়ে এসে গেছে যা বলা বাহুল্য। বিদেশি মিডিয়ার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে কমেছে দেশি মিডিয়ার দর্শক। বিদেশি মিডিয়াগুলোর প্রচারনাগুলো এমন যে অনেক মুভি নিজের পরিবারের সাথে সাবলীলভাবে দেখার মত নয়। যা আমাদের রুচিবোধ নষ্ট করছে। বলা যায়, এই মিডিয়াগুলো শুধু তরুন তরুনী নয় সব বয়সের মানুষদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এখন আমাদের ঘরের মা-বোনেরা ঘরের কাজ শেষ করেই বসে পড়েন টেলিভিশন বা স্মার্টফোনে বিদেশি সিরিয়াল নিয়ে, যেখানে নিজের দেশের সংস্কৃতি চর্চা তো দূরে থাক, বরং কীভাবে পরিবারের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করবে তা দেখানো হয়। যার ফলে বাড়ছে সংসারের অশান্তি। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদও ঘটছে। কিন্তু তারপরও এসবের প্রতিই যেন আমাদের আকষর্নের এতটুকু কমতি নেই। একবার ভেবে দেখুন কত নিখুঁতভাবে আমরা আমাদের ধ্বংস করছি। বিদেশী অপসংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশের কিছু মিডিয়াও দর্শক বাড়াতে তাদের অনুসরণ করে এমন সব কন্টেন্ট নির্মান করছে যা আমাদের গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমরা বর্তমান পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর অজুহাতে এখন অবাধে অপসংস্কৃতির চর্চা করছি। যা আমাদের দেশের পার্ক গুলির দিকে নজর দিলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। বিদেশী সংস্কৃতির ভালো দিকগুলি অবশ্যই গ্রহনযোগ্য। তবে সবকিছু নয়। কিছু কিছু দিক একজন বাঙালি হিসেবে আমাদের ব্যথিত করতে যথেষ্ট।
আমাদের সংস্কৃতি আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সমাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে যে মিডিয়াগুলো গেøাবালাইজেশন নামে অশ্লীলতা ছড়ায় অর্থনৈতিক সুবিধা থাকলেও সেগুলো নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। দেশের প্রখ্যাত একজন সাংবাদিক একটি সাময়িকী পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যদি গনতান্ত্রিক শিক্ষা বা প্রগতিশীল সংস্কৃতির প্রসার না ঘটে, তবে এই দেশের পরিবর্তন হবে না। এটার পাশাপাশি জোরদার সাংস্কৃতিক আন্দোলন লাগবে। এই জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি। যেখানে আমাদের বিরাট একটা পরাজয় ঘটে গেছে। এই পরাজয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে আমাদের মিডিয়ার প্রসার করা যেতে পারে, যেগুলোতে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সামাজিক কন্টেন্ট থাকবে, দেশীয় পন্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে, দেশীয় পোশাকের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।
অশ্লীলতা মুক্ত সমাজ গঠনে তৃণমূল পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংস্কৃতি বিষয়ক সভা-সমাবেশ, সেমিনার, বিতর্ক প্রতিযোগিতা করা যেতে পারে। তরুন প্রজন্মসহ সকলকে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে জানানো এবং পালনে উৎসাহিত করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সংস্কৃতি রক্ষায় আইন প্রনয়ন করা যেতে পারে। ইউনেস্কোর ‘কনভেনশন অন দ্য প্রোটেকশন অ্যান্ড প্রোমোশন অব দ্য ডাইভারসিটি অব কালচারাল এক্সপ্রেশনস (২০০৫)’ গবেষণায় বলা হয়েছে, স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি মানুষের অনুরাগ যত বেশি, সেই সমাজে শান্তি, ঐক্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত দ্রæত ঘটে। তাই আমাদের সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা কেবল আবেগ নয়, এটি আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বপ্নের বাংলাদেশ হবে সেই বাংলাদেশ, যেখানে সংস্কৃতির শিকড় গভীর থেকে গভীরতর হবে, আর আমরা সবাই একসঙ্গে গড়ব একটি সুস্থ, সুন্দর, বৈষম্যহীন সমাজ। নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষাই হোক আমাদের পাথেয়।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়