সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম এবং হোয়াটসঅ্যাপ, এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব মাধ্যমের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে পারি, তথ্য শেয়ার করতে পারি এবং বিভিন্ন সামাজিক, ব্যবসায়িক ও শিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারি। ২০২৩ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। একই সময়ে দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১১ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫%। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে, ডিজিটাল যোগাযোগ এখন দেশের মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
ফেসবুক, যা ২০০৪ সালে মার্ক জাকারবার্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কেবল একটি যোগাযোগ মাধ্যম নয়। এটি এখন সরকারি তথ্য প্রচার, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা এবং বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১২ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দপ্তরের পেজ চালু করে জনগণের কাছে তথ্য পৌঁছানোর জন্য। বর্তমানে ১২০টিরও বেশি সরকারি দপ্তরের পেজ রয়েছে, যা জনগণের তথ্যপ্রাপ্তি সহজতর করেছে। এ ছাড়া, এই মাধ্যম ছোট ও মাঝারি ব্যবসার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অনেকে ঘরে বসেই ফেসবুকে মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই সম্ভাবনার পাশাপাশি অপব্যবহারও দ্রæত বাড়ছে। মিথ্যা তথ্য, বিভ্রান্তিকর প্রচারণা এবং গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বন্যার সময় কিছু ভুয়া ছবি ও ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হয়। অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো বছরের বন্যার ছবি নতুন বন্যার ছবি হিসেবে প্রচার করা হয়। নোয়াখালীর জলাবদ্ধতার কয়েক বছরের পুরোনো ছবি নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। দ্য ডেইলি স্টার এ বিষয়ে সত্যতা যাচাই করে নিশ্চিত করে যে, এসব প্রচারণা ভুল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এর আগে, ২০২১ সালে কুমিল্লায় দুর্গাপূজার সময় ধর্মীয় গুজব ছড়িয়ে সহিংসতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাতের মিথ্যা খবর ছড়ানোর কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এই ধরনের গুজব শুধু স¤প্রীতির ক্ষতি করে না, বরং মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর মাধ্যমে কলুষিত করা হয়। এই ধরনের গুজব জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। এমন পরিস্থিতিতে তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি ব্যবহারকারীকে নিজের দায়িত্বের জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে। কোনো তথ্য বা ছবি শেয়ার করার আগে তার উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ভ্রান্ত তথ্য থেকে দূরে থাকা এবং সন্দেহজনক উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো ভুয়া খবর শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে করোনাভাইরাস নিয়ে ছড়ানো গুজব মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। ফলে অনেকেই ভ্যাকসিন নিতে দ্বিধায় পড়েছিলেন, যা জনস্বাস্থ্য সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক দিকগুলোও উল্লেখযোগ্য। বিশ্বব্যাপী সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। মি-টু আন্দোলন ও বø্যাক লাইভস ম্যাটার (বিএলএম) আন্দোলন তার উজ্জ্বল উদাহরণ। মি-টু আন্দোলন শুরু হয় ২০০৬ সালে, তবে ২০১৭ সালে টুইটারের মাধ্যমে এটি নতুন গতি পায়। এই আন্দোলনের ফলে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, বø্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি সহিংসতা ও বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে ২০১৩ সালে শুরু হয়। ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পর এই আন্দোলন বৈশ্বিক রূপ নেয়। ফলে বিভিন্ন দেশে বর্ণবৈষম্যবিরোধী নীতিমালা প্রণীত হয়েছে।
বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলনে ইতিবাচক ভ‚মিকা রেখেছে। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এসব মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ ধরনের সামাজিক আন্দোলনগুলো প্রমাণ করে যে, সঠিক ব্যবহারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শুধু যোগাযোগ নয় বরং গণসচেতনতার একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। তবে এই মাধ্যমের অপব্যবহার রোধে প্রশাসনকেও সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করতে হবে। ভুয়া তথ্য ও অপপ্রচার প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এটি একটি উন্নত সমাজ গঠনে সহায়ক হবে। শিক্ষার প্রসার, ব্যবসায়িক উন্নয়ন এবং সামাজিক আন্দোলনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য এই মাধ্যম অত্যন্ত কার্যকর। তবে ভুল তথ্য প্রচার এবং অপব্যবহার এড়িয়ে চলার দায়িত্ব আমাদের সবার। প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলেছে, কিন্তু এর অপব্যবহার সমাজে অশান্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা প্রযুক্তির সুফল গ্রহণ করতে পারি এবং একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এজন্য সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ অত্যন্ত জরুরি।
শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়