রংপুর, উত্তরের ঐতিহ্যের মুকুট, ইতিহাস ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধ এক ভূমি। একসময় দারিদ্র্য আর সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে পরিচিত হলেও রংপুর আজ সম্ভাবনার বাতিঘর। শ্যামল-সবুজে ঘেরা এই শহরের প্রতিটি ধূলিকণা যেন বলে যায় ইতিহাসের কথা। বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি এই রংপুরের সংগ্রামী নারীদের শক্তি আজও প্রেরণার উৎস। তিস্তা নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রংপুরের মানুষ প্রাণবন্ত সংস্কৃতি আর দারুণ মেহমানদারির জন্য পরিচিত। শতাব্দীর পুরনো কারমাইকেল কলেজের অঙ্গন যেন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আর ঐতিহ্যবাহী চিড়িয়াখানা থেকে শুরু করে পায়রাবন্দের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
সংস্কৃতির পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা মাটির গান, রংপুরের লাঠিখেলা কিংবা পিঠাপুলির উৎসব এখানকার মানুষদের বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলে। এর ঐতিহ্যবাহী মাটিতে রয়েছে দেবী চৌধুরানীর জমিদার বাড়ি, যেখানে ইতিহাস আজও জেগে আছে। পুকুর-পাড়ের শান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, উত্তরের শীতল বাতাস আর তিস্তা নদীর জলরাশি এই অঞ্চলকে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে। ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি, শীতকালীন পিঠা উৎসব, আর বৈচিত্র্যময় গান রংপুরের সংস্কৃতিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো যেমন পর্যটকদের আকর্ষণ করে, তেমনই এখানকার সংস্কৃতি তরুণদের ভিন্নধর্মী সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখায়। ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেনের আলোচনায় রংপুরের মানুষ তাদের ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং দক্ষতা উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন, যা নতুন প্রজন্মের কাছে সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে আসে। রংপুরের তরুণ প্রজন্ম আর পিছিয়ে থাকতে চায় না। তারা নিজেদের দক্ষতা দিয়ে দেশ ও বিশ্বে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইউএসএআইডির স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ (এসপিল) প্রকল্পের আওতায় ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল এই ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেনটি পরিচালনা করছে যাতে জনগণের প্রত্যাশা বাস্তবায়ন হয়।
‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেইনের রংপুরের তরুণ শিক্ষার্থীরা তুলে ধরেছেন অনেক সমস্যা। একজন শিক্ষার্থী দাবি করেন, সিটি করপোরেশন হওয়ার পর খেলার মাঠ কমে গিয়েছে। তিনি চান, খেলার মাঠ যেন বৃদ্ধি করা হয়। অন্য এক শিক্ষার্থী, রংপুরের ঐতিহ্যবাহী খাল ‘শ্যামাসুন্দরী’ কে দখলমুক্ত করার দাবি জানান। এরকম আরও অনেক দাবি উঠে এসেছে তরুণদের এই মিলনমেলায়। শুধু রংপুর নয়, দেশজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় চলমান ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেনে অংশ নিয়েছেন শিক্ষার্থী, গার্মেন্টসকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। বগুড়া, খুলনা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলমান এই সকল ক্যাম্পেনের কারণে মানুষ তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছে। যে সকল দাবি আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে পারেননি, সমাজের ভয়ে, চাকরি হারানোর ভয়ে কিংবা রাজনৈতিক চাপের কারণে, সেসব কথাগুলো উঠে এসেছে মানুষের কণ্ঠে। ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেনের আওতায়, মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরতে পারেন, যা সাধারণত সরকারি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে না।
রংপুরের সম্ভাবনার আলোচনায় উঠে এসেছে তরুণদের বিশ্বমানের নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা। বক্তারা বলেন, ‘অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং তরুণদের বৈশ্বিক কাজের জগতে প্রবেশ এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।’ ওডেস্ক, ফাইভার, আপওয়ার্কের মতো প্ল্যাটফর্মে কাজ করে অনেকে মাসে লক্ষাধিক টাকা উপার্জন করছেন। রংপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাগফুর হোসেন রিপন বলেন, ‘ইন্টারনেট ও মুঠোফোন ব্যবহার করে তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন করে তাদের বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে হবে।’ তার মতে, কর্মসংস্থানের সুযোগ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেন তরুণদের লক্ষ্য ও চাওয়াকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার উদ্যোগ। রংপুর সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম সেতু বলেন, ‘বেকারত্ব দূর করতে একাডেমিক শিক্ষা যথেষ্ট নয়; কারিগরি দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য।’ রংপুরের প্রেক্ষাপটে এই আলোচনা আরও গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত শিল্পায়ন নেই। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (ইঅঝওঝ) এবং বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (ইঋউঝ) অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ৬-৭ লাখ সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। তাদের একটি বড় অংশ ফ্রিল্যান্সিং থেকে বার্ষিক ৫০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি রেমিটেন্স আয় করছে। এটি তাদের দক্ষতা ও উদ্ভাবনী শক্তি বাড়ানোর অনুপ্রেরণা হতে পারে।
তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নের এই উদ্যোগ শুধু কর্মসংস্থান নয়, বরং রংপুরকে বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। দেশজুড়ে চলমান ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেনে নীতি আলোচনা ছাড়াও অনুষ্ঠানে ইন্টারেকটিভ থিয়েটার পারফরম্যান্স, কুইজ ও ভিডিও মেসেজ প্রতিযোগিতা এবং ক্যাম্পেনের রিল প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। মঞ্চনাটকে সূক্ষ্ম হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অসংগতি এবং দাবি তুলে ধরা হয়।
আর এসবের শুরুতেই ছিল ‘আমিও জিততে চাই’ স্লোগান। এটি অনলাইনে সরাসরি পোস্ট করার একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ‘ধসরড়লরঃঃবপযধর.পড়স’ ওয়েবসাইটে গিয়ে যে কেউ নিজের দাবি প্রকাশ করতে পারেন। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের এলাকার সমস্যাগুলো ছবি, ভিডিও কিংবা ব্লগ লেখার মাধ্যমে খুব সহজেই তুলে ধরতে পারেন, যেন এটি শুধু তাদের অভিযোগ না থেকে সামগ্রিকভাবে সমাজের উন্নয়নে কাজে লাগে। ‘আমিও জিততে চাই’ কেবল মানুষের ব্যক্তিগত কষ্ট প্রকাশের জন্য নয়, বরং এটি সামাজিক পরিবর্তনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ। এই প্ল্যাটফর্মের লক্ষ্য হলো, দেশের প্রান্তিক জনগণের কণ্ঠস্বর শোনা এবং প্রশাসনের নজরে আনা। প্রতিটি পোস্টে সহমর্মী মানুষেরা মন্তব্য করেন এবং সমর্থন জানান, যা সমস্যাগুলোকে প্রশাসনের কাছে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরার জন্য সহায়ক।
দেশজুড়ে চলমান এই ক্যাম্পেনে উঠে এসেছে ইভটিজিং, ট্রাফিক জ্যাম সংকট, নারীদের কর্ম অনিরাপত্তা, শ্রমিকদের সঠিক বেতন ভাতা না পাওয়া, ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য, অযথা নদী ও খাল দখল, রাজনৈতিক অসংগতিসহ সমাজের নানা সমস্যার কথা। তিস্তা নদীর স্রোতের মতোই রংপুর অঞ্চলের মানুষের ইচ্ছাশক্তি সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে। কারিগরি দক্ষতা, ফ্রিল্যান্সিং এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমন্বয়ে রংপুরের এই জাগরণ শুধু একটি অঞ্চলের নয়, বরং গোটা জাতির নতুন দিনের বার্তা বহন করছে। ‘আমিও জিততে চাই’ ক্যাম্পেনে সম্ভাবনার এই মেলবন্ধন যেন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার ইঙ্গিত দেয়। একটি বাংলাদেশ, যেখানে ইতিহাস আর আধুনিকতার সংযোগে গড়ে উঠবে উন্নয়নের স্থায়ী ভিত্তি।
‘আমিও জিততে চাই’
সাধারণ মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনা
শীর্ষ সংবাদ: