ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

কেবল সুসজ্জিত উচু দালান নয় উন্নত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রও

মারিয়া হাবিব

প্রকাশিত: ১৯:৪৮, ২২ নভেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২০:২৩, ২২ নভেম্বর ২০২৪

কেবল সুসজ্জিত উচু দালান নয় উন্নত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রও

বাংলাদেশের ইতিহাস সারা বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ইতিহাস। এমন দুঃসাহসী দেশপ্রেমী জাতি অনন্য অসাধারণ সারা পৃথিবীর বুকে। অন্যদিকে, ঠিক একইভাবে শিক্ষায় আমরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়া জাতি যা আমাদের দেশ জাতির জন্য লজ্জার ভবিষ্যতে জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়। আমাদের দেশের  উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থার একমাত্র মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির সাথে সবচেয়ে অবিচার হয়তো আমাদের দেশেই হয়। অনেকের মতে, বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশা চলছে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

 বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির অর্থ শুধু একটি স্থাপত্য নয়। এটি হলো জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র, গবেষণা নতুন ধারণা সৃষ্টির উৎসমুখ। একটি দেশের উন্নতি অনেকাংশেই নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। অথচ বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র দেখে মনে হয়, আমরা এখনো "বিশ্ববিদ্যালয়" শব্দটির প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারিনি। বর্তমানে দেশে অনেক নতুন সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। তবে এর মধ্যে 'টি প্রতিষ্ঠান মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পেরেছে! অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা মানেই আধুনিক বিল্ডিং নির্মাণ এবং নামমাত্র কিছু কোর্স চালু করা। গবেষণা, আধুনিক পাঠ্যক্রম, দক্ষ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব প্রকট।বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু ক্লাসরুমে পাঠদান নয়; এটি হলো এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে শিক্ষার্থী গবেষণার মাধ্যমে সমাজকে নতুন দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে গবেষণার সংস্কৃতি এখনো অনুন্নত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের গবেষণা প্রকাশনার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তাও প্রায় অনুপস্থিত।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সা¤প্রতিক সময়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশেষত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার দাবি ঘিরে আলোচনা তুঙ্গে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, শুধুমাত্র নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি কি আমাদের শিক্ষার মানোন্নয়নের সমাধান হতে পারে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজকে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি এখন আলোচনায় শীর্ষে। এই দাবি বাস্তবায়িত হলে কি শিক্ষার মান বাড়বে, নাকি শিক্ষার পরিধি বাড়ানোর নামে মান আরও নিচে নামবে তা নিয়েই এখন সংকট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকা অবস্থায়ই এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। ফলাফল বিলম্বিত হওয়া, প্রশাসনিক জটিলতা এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংযোগহীনতা এর কয়েকটি উদাহরণ। এসব সমস্যার সমাধান না করে শুধু নতুন নামকরণ দিয়ে "বিশ্ববিদ্যালয়" বানানোর চেষ্টা কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা ভাবার বিষয়।

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তাদের প্রধান মনোযোগ গবেষণার ওপর। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড কিংবা মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণার জন্য আলাদা তহবিল, বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি এবং দক্ষ শিক্ষক-গবেষক নিশ্চিত করা হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র অট্টালিকা নয়, বরং জ্ঞান প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য একটি উদার পরিবেশ তৈরি করা হয়। অপরদিকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চতর গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা হয় না। পদ্ধতিগত ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নিরুৎসাহিত হয়।  মূল সমস্যা আসলে কোথায়? গবেষণার অভাব, শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো নাকি রাজনৈতিক প্রভাব! দেশে উচ্চশিক্ষার পরিবেশে গবেষণার গুরুত্ব তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কিন্তু দক্ষ শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ছে না। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি ল্যাবরেটরির অবস্থা নাজুক। ছাত্ররাজনীতি এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা অনেক সময় শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নের জন্য শুধুমাত্র সংখ্যাবৃদ্ধি নয় বরং মৌলিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করা দরকার। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট  বরাদ্দ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, এবং শিক্ষার্থীদের  গবেষণার প্রতি উৎসাহিত করার মতো কার্যক্রম প্রয়োজন। সাত কলেজকে নতুন নাম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করার চেয়ে তাদের সমস্যাগুলো সমাধানে মনোযোগী হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কিছু অট্টালিকার ভিত শক্তিশালী করে যদি তার ভিতরটা শূন্য থাকে, তবে সেটি কখনোই জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারবে না। মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া শুধু অট্টালিকা গড়ে তুললে তা কোনো দিনই প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত অর্থ পূরণ করবে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। তাই সময় এসেছে শিক্ষার মান উন্নয়নে বাস্তবমুখী উদ্যোগ গ্রহণের।

 

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

×