পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী/ জীবের নাম আমাদের অনেকেরই হয়তো অজানা। যদিও এটা নির্ভর করে জীবটির ক্ষতি করার গতিপ্রকৃতি ও তীব্রতার ওপর। সবদিক বিবেচনায় পরিসংখ্যানই বলে দিতে পারে কোন জীবটির কারণে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ কত প্রাণ হারিয়েছে। এই প্রাণঘাতী জীবটির কার্যক্রমের কারণে সারা পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যু ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণী কি তাহলে আকার বা শক্তির দিক থেকে এেিগয় থাকা প্রাণী যেমন, বাঘ, সিংহ, তিমি ইত্যাদি? অথবা সবচেয়ে বিষাক্ত প্রাণী যেমন- বিষধর সাপ, বিচ্ছু বা অন্য কোনো বিষাক্ত প্রাণী? উত্তরÑ না। কেননা পৃথিবীতে অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রাণী উপরের বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে নির্ধারিত হয় নি। নির্ধারিত হয়েছে কোন প্রাণী প্রাণঘাতী জীবাণু বহন করে মানুষের সর্বোচ্চ মৃত্যু ঘটায় তার ওপর নির্ভর করে। সেই বিচারে ডিসকভার ওয়াইল্ড লাইফের এক জরিপে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে মশা। মশার দ্বারা সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর মৃত্যু হয় ৭,২৫০০০ হতে ১০০০,০০০ জন মানুষের। আর ২য় স্থানে রয়েছেÑমানুষ। যার দ্বারা মৃত্যুর পরিমাণ ৪,৩১০০০ জন, যেখানে সিংহ দ্বারা মানুষের মৃত্যু হয় মাত্র ১০০ জন ও নেকড়ে বাঘ দ্বারা হয় মাত্র ১০ জন। তাহলে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার ২য় স্থানে থাকা বিপজ্জনক প্রাণী মানুষের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য সেনাবাহিনী, বহিঃশত্রু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ল্যান্ডফোর্স, ইয়ারফোর্স নৌবাহিনী গঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তৈরি, ক্রয়-বিক্রয় এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন যেন সত্যিই এক হুলস্থ’ূল কারবার।
কিন্তু যে প্রাণীটি সবচেয়ে বেশি মানুষ মেরে ১নং অবস্থানে রয়েছে তার জন্য কতবড় আয়োজন দরকার তা একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। অথচ ডেডলিস্টের চুড়ায় থাকা প্রণীটির নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক প্রবচন প্রচলিত আছে ‘মশা মারতে কামান দাগানো’। হয়তো এই প্রবচনটি মশা নামক পতঙ্গের মধ্যে বেড়ে উঠা অদৃশ্য পরম ক্ষতাধর অণুজীবের ধ্বংসাত্মক প্রভাবের কারণেই প্রচলিত হয়েছে। এখান থেকেই বোঝা খুব একটা কঠিন নয় মশাবাহিত অণুজীবগুলো (ভাইরাস, প্রোটোকটিস্ট নেমাটোড ইত্যাদি) কত শাণিত ও শক্তিধর। মশার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাদাসিধা পুরাতন জংধরা কয়েকটি ফগার মেশিন নিয়ে আর যথার্থ একটিভ ইনগ্রিডেন্ট সম্পন্ন বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণিত গাইডলাইন অনুসরণ না করে মোকাবিলা করতে গেলে কত ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিরক্তিকর উপদ্রবের পাশাপাশি তারা রোগজীবাণু সংক্রামণ করে। এই মশা অনেক সময় মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। মশার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীত জ্বর, জিকা ভাইরাস প্রভৃতি মারাত্মক রোগ সংক্রমিত হয়ে থাকে। স্প্রে, কয়েল, অ্যারোসল ব্যবহার করেও অনেক সময় মশা তাড়ানো সম্ভব হয় না। আবার এসব দিয়ে মশা তাড়ালেও আমাদের স্বাস্থ্য এতে চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
আমরা মশা নামক মহাশত্রুকে নানা উপায়ে নিবিরপরিচর্যা ও বংশবিস্তারে সাহায্য করার মাধ্যমে এমন শক্তিশালী করে তুলছি যে, এখন যেন পতঙ্গটি আর তারআক্রমণকে নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছে না। আবার আক্রমণের তীব্রতাও এমনভাবে বৃদ্ধি করেছে যাতে শত্রুর মৃত্যু নিশ্চিত হয়। কারণ সকল প্রতিকূলতা রপ্ত করার জন্য আমরাই সকল অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছি। আমাদের এই বেহাল দশায় পূর্বে উল্লেখিত প্রবচনটির যথার্থতা উপলব্ধি করতে পারছেন নিশ্চয়। তাই আসুন মশা মারতে কামান নয় সকলের সমন্বিত প্রতিরোধ কার্যক্রম ও সচেতনতা আশু প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রথম কাজটিই হবে শত্রুর উৎপত্তিস্থল চিহ্নিতকরণ ও ধ্বংস করা। দ্বিতীয় কাজটি হবে শত্রুর দুর্বল জায়গায় আঘাত করা। অর্থাৎ মশার জীবনচক্রের সবচেয়ে দুর্বল ধাপ হলো লার্ভা। এই লার্ভা বিনাশ করা। তৃতীয়ত, অনুকূল পরিবেশের ফলে জিনগত ও শরীরবৃত্তীয় যে পরিবর্তন হয়েছে তার বিপরীতে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা। অর্থাৎ পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখে জৈবিকদমন ও যুক্তিযুক্ত কীটনাশকের সঙ্গে প্রয়োজনীয় জৈবশত্রুর যথাযথ ব্যবহার করা। তাছাড়া মশা যে কোনো স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় জমে থাকা স্থির পানিতে বংশবিস্তার করে। তাই আপনার বাড়ির চারপাশে উন্মুক্তভাবে জমে থাকা পানির উৎসগুলো নির্মূল করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নজর দিতে হবে নর্দমার দিকে, যেন মশা ডিম পাড়তে না পারে। পুকুর বা ফেলে দেওয়া জিনিসগুলোতে জমে থাকা খুব অল্প পরিমাণ পানিও মশার প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। এর জন্য ফুলের পাত্র, পোষ্য প্রাণির ঘরে থাকা পাত্রের মতো যাবতীয় পানির পাত্রগুলো নিয়মিত খালি ও পরিষ্কার করতে হবে। সেই সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণে উন্নতমানের ল্যাব, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গবেষক ও বিজ্ঞানী এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা