ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ইমাম মাহদী

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ১৯:৪৭, ২১ নভেম্বর ২০২৪

ইমাম মাহদী

আরবী ভাষায় ‘আল-মাহদী’ শব্দের অর্থ হলো পথ প্রদর্শিত ব্যক্তি। এখানে মাহদী বলে কিয়ামতের প্রাক্কালে হযরত ঈসা (আ.) এর অবতরণ ও দাজ্জালের প্রকাশের পূর্ব মুহূর্তে মুসলিম নেতৃত্বের জন্য যে সংস্কারক মনীষীর আবির্ভাবের কথা আছে তাকেই বুঝানো হয়েছে। মুহাক্কিক আলিমগণের মতে কিয়ামতের প্রাক্কালে ইমাম মাহদির আবির্ভাব সত্য। বহু সহিহ  হাদিস দ্বারা এ কথা প্রমাণিত। ইমাম মাহদীর ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসগুলো দুভাগে বিভক্ত। (১) যে সব হাদিসে সরাসরি ইমাম মাহদীর বর্ণনা এসেছে। (২) যে সব হাদিসে শুধু তার গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। ইমাম মাহদির ব্যাপারে প্রায় অর্ধশত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এর কিছু সহিহ, কিছু হাসান, আর কিছু যয়ীফ বা দুর্বল। প্রায় আঠারোটির মতো আছার (সাহাবাদের বাণী) বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ছাফারিনী, সিদ্দিক হাসান খান এবং হাফেয আবেরী (র.) ইমাম মাহদী সংক্রান্ত হাদিসগুলোকে  পৌনঃপুনিকতার (মুতাওয়াতির) স্তরে উন্নীত করেছেন। বিন বায (র.) বলেন, ইমাম মাহদী প্রকাশের বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ। এ ব্যাপারে নবী করীম (সা.) থেকে প্রচুর হাদিস প্রমাণিত রয়েছে। একাধিক সাহাবী (রা.) থেকে পরস্পর বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার অপার রহমতে তিনি শেষ জামানায় ইমাম হবেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন। অন্যায়-অবিচার দমন করবেন। শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবেন। তার আত্মপ্রকাশে উম্মতের মধ্যে জিহাদের  চেতনা ফিরে আসবে। সকলেই এক কালেমার পতাকাতলে একত্রিত হয়ে যাবে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না যতক্ষণ আরবের আধিপত্য বিস্তারে এমন এক ব্যক্তির  (মাহদী) আবির্ভাব না ঘটবে যে হবে আমারই বংশের একজন এবং আমার নামে হবে তার নাম। (তিরমিযি শরীফ)। হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের শেষকালে মাহদীর আবির্ভাব ঘটবে। তাঁর শাসনামলে আল্লাহ তায়ালা প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। ভূমি থেকে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তিনি সকলের মধ্যে প্রয়োজনীয় রসদ সমানভাবে বণ্টন করে দিবেন। পশু সম্পদের বৃদ্ধি ঘটবে। পৃথিবীতে এ উম্মত তখন অতি সম্মানের অধিকারী হবে। সাত আট বছর পর্যন্ত এভাবে চলবে। (হাকিম তরজমানুস সুন্নাহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ ৩৯১)
অপর একখানা হাদিসে হযরত হুযাইফা (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) যখন অবতরণ করবেন তখন ইমাম মাহদী দেখতে পাবেন যেন তার মাথার চুল থেকে পানি ঝরছে। মাহদী তখন তাকে বলবেন, আসুন এবং নামাজের ইমামতি করুন। হযরত ঈসা বলবেন, আপনি নামাজ পড়াবেন বলে ইকামত হয়ে গেছে কাজেই আপনিই নামাজ পড়ান। নবী করীম (সা.) বলেন, একথা বলে হযরত ঈসা (আ.) আমার বংশধরের একজনের পেছনে নামাজ আদায় করবেন- (প্রাগুক্ত)।
ইমাম মাহদীর আবির্ভাব সময়কাল ও তার নাম নিয়ে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন মতাদর্শের আলেমদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত নবী করীম (সা.) থেকে বর্ণিত হাদিসসমূহে ইমাম মাহদীর পরিচয় সম্বন্ধে এমন অভিমত পোষণ করে থাকেন যে, তিনি সাইয়িদ বংশ হযরত ফাতিমা (রা.) এর বংশ থেকে হবেন। শারীরিক গঠন সামান্য লম্বা, উজ্জ্বল বর্ণের হবে। চেহারার আকৃতি নবী (সা.) এর আকৃতির মতো হবে। নাম মুহাম্মদ হবে ও পিতার নাম হবে আবদুল্লাহ। মাতার নাম হবে আমিনা। তার মুখে মৃদু জড়তা থাকবে। সে কারণে মাঝে মাঝে মনোক্ষুণ্ন্ন হয়ে উরুর ওপর হাত মারবেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি ইলমে লাদুনী বা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ আধ্যাত্ম্য জ্ঞানপ্রাপ্ত হবেন- (আলামতে কিয়ামত, শাহ রফিউদ্দীন)। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে তিনি মদীনার পূর্বাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করবেন। এ সময় মক্কা মদীনা কেন্দ্রিক প্রায় ৭০ এর মতো কলহ বিবাদ সংঘটিত হবে। শাহ রফী উদ্দীন (র.) আরও বলেন, মুসলমানদের বাদশাহ শহীদ হওয়ার পর সিরিয়া খ্রিস্টানদের কাতারে চলে যাবে এবং খ্রিস্টান বিবদমান দু’দলের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হবে। অবশিষ্ট মুসলমানরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করবে। খ্রিস্টানদের আধিপত্য খাইবার পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং এ সময় মুসলমানগণ ইমাম মাহদীর সন্ধান করতে থাকবে। যেন তার নেতৃত্বে আপাতত সমস্যা থেকে মুক্তি ও শত্রুদের হাত থেকে রেহাই লাভ করতে পারে।
এ অবস্থা চলাকালীন সময় ইমাম মাহদী মদীনাতেই অবস্থান করবেন। কিন্তু জিম্মাদারী অর্পিত হওয়ার আশঙ্কায় মক্কা শরীফ চলে যাবেন। সেখানেও তৎকালের অলী আবদালগণ ইমাম মাহদীর সন্ধান চালাতে থাকবে। ইত্যবসরে কতিপয় ব্যক্তি নিজেদের মাহদী বলে মিথ্যা দাবি করতে থাকবে। ইতোমধ্যে একদিন রুকনে ইয়ামেনী ও মাকামে ইবরাহীমের সঙ্গে বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফের মুহূর্তে লোকজন তাঁকে চিনে ফেলবে এবং তাঁর হাতে বাই’আতের জন্য তাঁকে বাধ্য করবে। এ ঘটনার সত্য হওয়ার একটি চিহ্ন হবে এমন যে যার পূর্বেকার রমজান মাসে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ হবে এবং বাই’আতের মুহূর্তে অদৃশ্য থেকে একটি আওয়াজ আসবে যে, হাযা খলিফাতুল্লাহিল মাহদী ফাসতামিঊ লাহু ওয়া তীয়ুহ।’ অর্থাৎ ইনিই হলেন আল্লাহর সত্য পথ প্রাপ্ত খলীফা ইমাম মাহদী। সুতরাং তোমরা তার কথা শুনো এবং তাঁকে অনুসরণ করো।’  আওয়াজটি সেখান থেকে সকলেই শুনতে পাবে। বাই’আতের সময় ইমাম মাহদীর বয়স হবে চল্লিশ বছর। তাঁর খিলাফত গ্রহণের সংবাদ মদীনায় পৌঁছলে মদীনার  সৈন্যগণ মক্কায় ছুটে আসবে। সিরিয়া, ইরাক ও ইয়ামেনের বুজর্গানে দ্বীন তাঁর সান্নিধ্যে এসে একত্রিত হবেন। তাঁদেরকে নিয়ে তিনি অসংখ্য সেনাবাহিনীর একটি দল গঠন করবেন এবং কা’বা শরীফের মাটির নিচে রক্ষিত ভাণ্ডার তুলে এনে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দিবেন। ইমাম মাহদী (মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ) নিজেও জানবেন না যে, হাদিসে উল্লিখিত ব্যক্তিটি তিনিই। আগেভাগে গিয়ে খিলাফতও কামনা করবেন না। নম্রতাবশত নিজেকে তিনি নেতৃত্বের অযোগ্য মনে করবেন। আর তাই প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষ জোর করে তার হাতে বাইআত হয়ে যাবে।
শী’আরা অবশ্য তাদের ইমামদের সুদীর্ঘ জীবনকালের কথা ঘোষণা করেছেন যে, তিনি তৃতীয় শতকে জন্ম নিলেও কিয়ামত পূর্বকাল পর্যন্ত বেঁচে আছেন। (শরহে আকাইদ, পৃ. ১৪; ফাতওয়া ও মাসাইল ১ম খণ্ড)। আমাদের মনে আছে বেশ কয়েক বছর আগে খোদ মক্কার মসজিদে কাবা শরীফের আঙ্গিনায় এমন একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ইমাম মাহদী ও তার অনুসারী দাবি করে বসে। এ নিয়ে কয়েকদিন পবিত্র মসজিদে রক্তারক্তি হয়। পরে পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশের কমান্ড বাহিনী তা আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানের লাহোরেও এমন দাবিদারের উদ্ভব ঘটেছিল। ইমাম মাহদী  কোনো পাপী বা পথভ্রষ্ট হবেন না। (যেমন মিথ্যা মাহদীর দাবিদার গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী পাপী ও পথভ্রষ্ট।) বরং শরীয়ত বিষয়ে একজন সুপরিপক্ব ব্যক্তি হবেন। মানুষকে হালাল-হারাম শেখাবেন। বিচারব্যবস্থাকে শরীয়তের আলোকে ঢেলে সাজাবেন। শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রধান  সেনাপতির ভূমিকা পালন করবেন। তিনিই প্রতীক্ষিত মাহদী। এক রাত্রিতে আল্লাহ তাআলার নেতৃত্বের সার্বিক  যোগ্যতা তাঁকে প্রদান করবেন। হযরত উম্মে সালামা (রা.)  থেকে বর্ণিত, নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মাহদী আমার বংশে ফাতেমার সন্তানদের মধ্যে হবে। (আবূ দাউদ-১১/৩৭৩)
হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মরিয়ম-তনয় ঈসা (আ.) আসমান হতে অবতরণ করবেন। মুসলমানদের সেনাপ্রধান মাহদী তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বলবেন, আসুন! নামাজের ইমামতি করুন। ঈসা (আ.) বলবেন, না, (তুমিই ইমামতি করো)। তোমাদের একজন অপরজনের নেতা। এই উম্মতের জন্য আল্লাহ তাআ’লার পক্ষ থেকে এ এক মহা সম্মান। (ইবনুল কাইয়িম রহ.-এর ’আল-মানার’ল মুনীফ’ ১৪৭-১৪৮ পৃষ্ঠায় লিখেন, হারেস বিন আবূ উসামা স্বীয় মুসনাদে সবল সূত্রে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন)। এ হাদিস দ্বারা বুঝা গেল, ইমাম মাহদীর সময়েই দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। অতঃপর দাজ্জালকে হত্যা করতে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আসমান থেকে অবতরণ করবেন। ইমাম মাহদীই তখন সেনাপ্রধান থাকবেন।
হযরত ঈসা (আ.) এবং অন্য সকল মুসলমান ইমাম মাহদীর পেছনে ফজরের নামাজ আদায় করবেন। নামাজ শেষে হযরত ঈসা (আ.) সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিবেন আর ইমাম মাহদী তার সেনাদলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সেনা সদস্য হবেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পৃথিবীর জীবনসায়াহ্নে যদি একটি মাত্র দিন অবশিষ্ট থাকে, তবে সে দিনটিকে আল্লাহ তাআলা দীর্ঘ করে আমার পরিবারস্থ এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন। তার নাম আমার নাম এবং তার পিতার নাম আমার পিতার নামসদৃশ হবে। (তিরমিযী-২২৩০/আবূ দাউদ-৪২৮৪)। সুতরাং শিয়া সম্প্রদায়ের দাবি সম্পূর্ণ ভুল। কারণ, মুহাম্মাদ বিন হাসান আসকারীকে তারা মাহদী মনে করে থাকে। অথচ মাহদী তো হবেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রা.।
বর্ণনায় এসেছে ইমাম মাহদী মানুষের মাঝে সম্পদ বণ্টন করবেন। নববী আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটাবেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ইসলাম সেদিন ভূপৃষ্ঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। সাত বছর এভাবে রাজত্ব করে তিনি ইন্তেকাল করবেন। মুসলমানগণ তার জানাজায় শরিক হবে। (আবূ দাউদ-৪২৮৮)। প্রায় ত্রিশোর্ধ-জন সাহাবি থেকে ইমাম মাহদী (রা.) সংক্রান্ত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত হাদিস গবেষকগণ শক্তিশালী বর্ণনাসূত্রে এগুলো বর্ণনা করেছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল উলামায়ে কেরাম ইমাম মাহদীর প্রকাশের বিষয়ে একমত। হায়াতে এ মহান ইমামের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে কথা নেই। কিন্তু তার আগমন ও কেয়ামতের বিভিন্ন লক্ষণ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকতে হবে এবং যুগের নানা চিহ্ন, পরিস্থিতির আলোকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নামে অধিক সিজদাহ অবনত হতে হবে।  
লেখক  :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব
সরথৎধভরয়@ুধযড়ড়.পড়স

×