ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

আসন্ন রমজান এবং মূল্যস্ফীতি-মূল্যবৃদ্ধি

ড. মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৯:৩৯, ২১ নভেম্বর ২০২৪

আসন্ন রমজান এবং মূল্যস্ফীতি-মূল্যবৃদ্ধি

বাংলাদেশে ২০২৫ সালে পবিত্র রমজান মাসের সাওম বা রোজা রাখা শুরু হতে পারে ২ মার্চ। ইসলামের অন্যতম এই স্তম্ভ মানুষকে সংযম শিক্ষা দেয়। কিন্তু এখনো কমবেশি ৯০ দিন বাকি থাকলেও বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই রমজান নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সংযম শিক্ষা বা ধর্মীয় কারণে নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতির বদৌলতে। প্রথাগতভাবে বাংলাদেশে পবিত্র রমজানে মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটি গুরুতর সমস্যা। তার ওপর দেশে এখন চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবণতা। প্রচণ্ড চাপে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ, যাদের কষ্টার্জিত উপার্জনের সবটুকুই মাসের বড়জোর ২০ দিনের মধ্যেই শেষ হয়, বাকি ১০ দিন চলে ধারকর্য অথবা সঞ্চয় ভেঙে। এই অবস্থায় কীভাবে আসন্ন রমজানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা থেকে জনগণকে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে মাত্র ১০০ দিন আগে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারও রয়েছে দুর্ভাবনায়, যার প্রমাণ পাওয়া যায় পবিত্র রমজানের অতিপ্রয়োজনীয় চাল, গম, পিঁয়াজ, ডাল, ভোজ্য তেল, চিনি, ডিম, ছোলা, মটর, মসলা, খেজুরের মতো খাদ্যপণ্য আমদানিতে বিলম্বে বিল পরিশোধের অনুমতি ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও কিছু নির্দেশনায়। এখন এসব পণ্য ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানি করা যাবে, আমদানির ক্ষেত্রে আগের মতো ১০০ শতাংশ মার্জিন বা জামানত লাগবে না, তুলে দেওয়া হয়েছে সিঙ্গেল বরোয়ার (ব্যক্তির একক ঋণ) লিমিটও। পাশাপাশি রাজস্ব বোর্ডও উল্লিখিত পণ্যের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির পারদ কমার বদলে আরও উপরের দিকে চড়ছে।
এমন এক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, বিশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থার কারণে আসন্ন রমজান মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপক সমালোচনা ও চাপের মুখে পড়তে পারে। বিশেষত, অর্থনীতির অলিগলি না বুঝতে চাওয়া সাধারণ মানুষ এবং ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক শক্তির পক্ষ থেকে এবং এদের ইন্ধন জোগাতে পারে দুর্বৃত্তায়িত ব্যবসায়ী ও প্রশাসনিক গোষ্ঠী। বিশ্লেষকদের এমনতর আশঙ্কার কারণ, নানা পদক্ষেপ নিয়েও মূল্যস্ফীতি না কমে বরং বাড়তে থাকা এবং ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের সিন্ডিকেট-চাঁদাবাজি চক্রের ক্রমান্বয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার প্রবণতা। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সীমাবদ্ধতা ও অসহায়ত্ব নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করা। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা চাইলেই সব কিছু পারি না, আমাদেরও কিছু বাধা আছে।’ কিন্তু ছাত্র-জনতার বিপুল সমর্থন পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে অসহায়ত্ব প্রকাশের বিষয়টি অর্ধৈয জনগণ ও নতুন আগমন ঘটা বুদ্ধিজীবীদের মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। বিশ্লেষকরা মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞানের অঙ্গনে বিচরণ করা মানুষজনের এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। তাই মূল্যস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধি প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও এখন কিছু দায়িত্ব ও করণীয় আছে। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারের জ্ঞানাভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা আগে থেকেই কেন মূল্যস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধি ঘটে তা জানেন, সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে ভেতরের কারণগুলোও জানছেন। এখন জনসাধারণকেও বুঝতে হবে, দুর্বৃত্তায়িত আর্থ-সামাজিক-রাজনীতির পাকচক্রে পড়ে যাওয়া বাংলাদেশে কীভাবে একটি সিন্ডিকেট-চক্র জরুরি নিত্যপণ্য আমদানি করা থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে, কীভাবে তারা কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার হাতে তুলে দিয়ে মূল্যস্ফীতি-মূল্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের প্রধান আমদানি কেন্দ্র বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ছোট ব্যবসায়ীদের অকপট স্বীকারোক্তির মাধ্যমে আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির বিষয়টি পর্যালোচনা করা যায়। ‘বড় ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে ব্যবসা ভাগাভাগি করছে বলেই আমরা ছোটরা রেস থেকে ছিটকে গেছি। তাদের অবাধ্য হয়ে কোনো ব্যবসাই আমরা এখানে করতে পারব না। এখানে সিন্ডিকেটের বাইরে কিছু কল্পনাও করা যায় না।’ পুরো চিত্র পাওয়া যায় তাদের ভাষ্যে, ‘বড় ভলিউমে পণ্য আমদানি করা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একজোট হয়েছে। এখন মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ওই বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে নিজের ইচ্ছেমতো পণ্য কিনতে পারেন না। উদাহরণস্বরূপ একজন উদ্যোক্তা ভাবলেন, তিনি ১০০ কোটি টাকার চিনি বা লবণ কিনবেন। সে জন্য বড় ব্যবসায়ীদের কাছে গেলে তারাই ঠিক করে দেন যে কোনো পণ্য কত দামে কার কাছ থেকে কিনতে হবে। এতে রাজি না হয়ে উদ্যোক্তাটি যদি মনে করেন, তিনি নিজেই ব্রাজিল থেকে ১০০ কোটি টাকার চিনি আনবেন, সে অনুযায়ী তিনি আমদানিও করলেন। বড় ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট গোষ্ঠী ‘বেত্তমিজ’ ওই উদ্যোক্তার আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে বাজারে চিনি ছেড়ে দিয়ে তাকে লোকসানে ফেলে দেবে। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, সিন্ডিকেটের বাইরে গিয়ে বা তাদের সিগন্যাল ছাড়া কোন পণ্য আনলে সেগুলো বন্দরে আনার জন্য লাইটার ভেসেল পর্যন্ত পাওয়া যায় না। এমনকি শ্রমিক গোষ্ঠীও ওই পণ্য খালাসের কাজ করতে চায় না। ফলে অন্যদের আমদানি করা পণ্য কত দিন সাগরে বা জাহাজে পড়ে থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। আবার খালাস হলেও কাস্টমস ও কর বিভাগ ছাড়পত্র দেবে না। অন্যদিকে বেশি দৌড়ঝাঁপ-ক্ষমতা দেখালে স্বেচ্ছায় ব্যাংক (ব্যাংকও ওই সিন্ডিকেটের মালিকানায়) এগিয়ে এসে ওই ব্যবসায়ীকেই মুক্তহস্তে ঋণ দিয়ে দেবে। তারপর বড় ব্যবসায়ীরা কম দামে পণ্য ছেড়ে দিয়ে তাকে লোকসানে ফেলবে। আর ব্যাংক তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমায় ফেলে জামিনযোগ্য অপরাধ হলেও ওই ব্যবসায়ীকে সোজা জেলে পুড়ে দেবে। এক কথায়, রাজনীতি-প্রশাসন-ব্যাংক-বিচার-সংসদ সবই ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের দখলে। এভাবে প্রতিটি পদে পদে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে সিন্ডিকেট। টাকা থাকলেও এদের সাথে কেউ পেরে উঠবে না। প্রতিদিন প্রয়োজন এমন ১৭টি পণ্যই এই সিন্ডিকেটের দখলে। এমনকি সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলে অথবা জেল-জরিমানা করলে সিন্ডিকেট তার পণ্য জাহাজেই রেখে দেবে, নয় তো সমুদ্রেই জাহাজ ডুবিয়ে দেবে (বীমা তো করাই আছে); যাতে সংকটে পড়ে সরকারই বলে ‘আব্বা, দাম যা-ই হোক তাড়াতাড়ি পণ্য আনুন’। অর্থাৎ, ‘ভিক্ষা চাই না, কুকুর সামলান’ অবস্থা।
এবার আসা যাক, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে। ২০ টাকা কেজি শসাকে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যাক। প্রথম ধাপে পণ্য উৎপাদনকারী কৃষকের পর ৬ বার হাতবদল হয়ে ভোক্তা (কৃষক থেকে বড় পাইকার-মহাজন, সেখান থেকে কোল্ড স্টোরেজ-গুদাম মালিক, সেখান থেকে রাজধানীর আড়ত-কমিশন এজেন্ট, সেখান থেকে ছোট পাইকার, তার কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতা; তার কাছ থেকে ভোক্তার হাতে)। দ্বিতীয় ধাপে পণ্য পরিবহন পথে ১০ জায়গায় চাঁদাবাজি (রাজনীতিবিদ ও দলের ৩টি হাত, পুলিশের ২টি হাত, প্রশাসন ২টি হাত, পরিবহন সমিতি ২টি হাত, ব্যবসায়ী সমিতি ১টি হাত, মস্তান-সন্ত্রাসী ১টি হাত)। তৃতীয় ধাপে ব্যবসায়ীর অতিরিক্ত মুনাফা (জ্বালানি তেল, বিশ^বাজারে দাম বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা অজুহাত)। পরের ধাপগুলোয় যথাক্রমে আইনে ইচ্ছাকৃত ফাকফোঁকর রাখা, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে আইন বাস্তবায়ন না করা এবং যথাযথ নজরদারি না করা। প্রতিটি পর্যায়ে যদি ন্যূনতম ২-৩ টাকা করে অতিরিক্ত গুনতে হয় তাহলে এমনিতেই তো ২০ টাকার শসা ৭০ টাকা হয়ে যায়। তারপরও বাজারে গেলে দুয়েকটি পণ্য ছাড়া ১০০ টাকা কেজির নিচে কোনো শাক-সবজি পাওয়া যায় না। আর এখন সামনেই আসছে, পবিত্র রমজান মাস; সিন্ডিকেট-ফাউখাওয়া-পরজীবীদের জন্য উৎকৃষ্টতম রিজিকের মাস। এই ত্রিচক্রের সম্মিলিত সিন্ডিকেটের ইচ্ছাকৃত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনকে গুরুতর সংকটে ফেলে দিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারকেও এখন প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে। সামগ্রিক বাস্তবতা হচ্ছে, যখন বাড়তে থাকে তখন একটার পর একটা পণ্যের দাম বাড়ে। ডিমের দাম না কমতেই আলু, আলুর দাম না কমতেই পেঁয়াজ। তারপর তেল, চিনি, কাঁচামরিচ। বাদ যায় না কিছুই। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের দাম যখন বাড়ে, তখন সব কোম্পানিই বাড়াতে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাম বাড়ে সিন্ডিকেটের ত্রিমাত্রিক প্রভাবে। তারপরও তথাকথিত অনেক অর্থনীতিবিদও সিন্ডিকেটকে ‘নন্দঘোষ’ বলছে, কল্পিত বলছে। বরং সত্যিটা হচ্ছে, রুটিন করে দাম বৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেট চক্রের রীতিমতো শিক্ষাথীদের অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডরের মতো ‘প্রফিট ক্যালেন্ডার’ও আছে, যাতে করে এসডিজি লক্ষ্যের দর্শনে ‘কেউ পিছিয়ে না থাকে’।
সবচেয়ে দুভার্গ্যজনক হচ্ছে, সিন্ডিকেট ভাঙতে দেশে শক্তিশালী কোনো আইনও নেই। যতটুকু যা ছিল, তা-ও এই সিন্ডিকেট চক্র আইন প্রণয়নের জাতীয় সংসদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সুকৌশলে উচ্ছেদ করে ছেড়েছে। ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন করা হয়েছিল। এ রকম কাজ করলে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি মন্ত্রী-মিনিস্টাররা কিছুদিন আগেও দিয়েছিল। পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ তফসিলি অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশকে প্রতিস্থাপনের জন্যে করা ওই আইনে চোরাচালান, কৃত্রিম সংকট তৈরি, মজুত ও ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত যে-কাউকে সরকার আটক করে দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা এখনো করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার ওই আইনে ধারা সংযোজন করে খাদ্য, পানীয়, ওষুধ ও প্রসাধনী দ্রব্যে ভেজাল, মজুত, অপরাধ করার ষড়যন্ত্র করা এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আরও কিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু সঙ্গে শুভঙ্করের ফাঁকিও জুড়ে দেয়, ‘যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রমাণ করতে পারেন যে তিনি লাভ ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে মজুত করেছিলেন, তবে তিনি তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে জরিমানাও করা হবে তাকে।’ এই সুযোগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রেই এই আইনে ৫০ বছরে শাস্তি দেওয়ার নজির নেই। ফলে এই আইনটি এখন ‘কালো আইন’, প্রয়োগ করলেই সুবিধাভোগীদের ‘গেল গেল’ রব ওঠে। আবার বর্তমানে ঢাকঢোল করে প্রয়োগ করা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এর ২ (২০) (ক) ধারা অনুযায়ী, কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা বেশি মূল্যে কোনো পণ্য, ভেজাল ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এই আইনে প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক কোনো ক্ষমতা নেই, মামলা করার ক্ষমতা নেই। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ার বলতে, সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা। এই পরিমাণ টাকা তো সিন্ডিকেট চক্রের ক্ষুদ্র কুশীলবরা মাত্র ১-২ দিনেই উপার্জন করেন। ১১ জুলাই, ২০২৩-এ রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন ২০২৩’-এ নির্ধারিত পরিমাণের পণ্য অধিক নির্দিষ্ট মেয়াদের অতিরিক্ত সময় মজুত করে রাখলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন বা অনূর্ধ্ব ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড এবং যৌক্তিক কারণ প্রমাণ করতে পারলে ৩ মাসের শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু এ পরিমাণ শাস্তি হয়েছে, তার নজির নেই। উপরন্তু এখন আবার অন্তর্বর্তী সরকারকে পতিত সরকারের পুলিশ-প্রশাসন-ব্যবসায়ী সুবিধা-উপকারভোগী তো দূরের কথা, ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর বিদ্যমান রাজনৈতিক শক্তিগুলোও নানা চাপে রাখছে।
এমন এক বাস্তবতায় স্বভাবতই পবিত্র রমজান মাসে মূল্যস্ফীতির মধ্যে মূল্যবৃদ্ধি প্রবণতা জটিল আকার ধারণ করতেই পারে। তারপরও সংকট কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে, যদি সরকার সত্যিকার সদিচ্ছা নিয়ে শক্তিশালী বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মৌলিক সমস্যাগুলো প্রকাশ করে জনমত গড়ে তুলতে পারে এবং সাধারণ মানুষ সচেতনতা ও সাশ্রয়ের মনোভাব নিয়ে কাজ করে। রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত সরকার ও জনগণ উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব, যাতে সবার জীবনযাত্রা আরও সহজ ও সহনশীল হয়।


লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ সম্পাদক,
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

×