নারী হচ্ছে মহাশক্তির আধার। নারীকে গৃহবন্দি করে রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দীর্ঘ সময় ধরে। যা থেকে এখনো আমরা পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারিনি। বেগম রোকেয়া সেই অর্গল ভেদ করে নারীকে দিয়েছেন মুক্তির দিশা। তথাপিও পুরোদস্তুর সেই মুক্তির স্বাদ আস্বাদনে নারী রয়েছে অনেকটা পিছিয়ে। অথচ নারীরা যতবেশি এগিয়ে যাবে, সমাজ ও রাষ্ট্র হবে ততবেশি সমৃদ্ধ। নারীর যোগ্যতা ও সক্ষমতা অবমূল্যায়নহেতু সমাজ প্রগতির চাকা বেগবান হচ্ছে না তেমন করে। বিশ্ব দরবারে দেশকে পরিচিত করার অন্যতম মাধ্যম ক্রীড়া, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি এবং আবিষ্কার। বিশেষত ক্রীড়া অন্যতম। তবে মেয়েদের খেলাধুলা আর বাংলা সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠতে পারল না। কিন্তু মেধা ও সাংস্কৃতিক প্রতিভার বাইরে মেয়েদের সামাজিক পরিচয় তৈরি ও স্বনির্ভরতা লাভের দৌড়ে খেলাই ছিল ভরসাযোগ্য সুস্থ এক মাধ্যম। এ দেশে চিরকাল খেলা পুরুষতান্ত্রিকতার ধাঁচে বিশ্লেষিত। এই প্রথা ভেঙে খেলার মাঠে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা নারীত্বের এক সামাজিক চ্যালেঞ্জ। তবু চার পাশের সব বাধা ও নিষ্ঠুরতা অতিক্রম করে মেয়েরা খেলছে, সামাজিক সাম্যের রজতরেখা সেটুকুই। নারীত্বের কিছু কাল্পনিক অথচ প্রতিষ্ঠিত সামাজিক নিয়মাবলি আছে। মেয়েদের ক্রীড়া-অবরোধের জন্য সেই নিয়মাবলিগুলোই যথেষ্ট। সে কারণে ফুটবলের মতো ‘বডি-কন্ট্যাক্ট গেম’-এ আসা অধিকাংশ মেয়ের পরিবার একটা নির্দিষ্ট সীমার পর আর ঘরের মেয়ের ক্রীড়ানিপুণ হয়ে ওঠায় সহযোগিতা করে না। এমনকি পাড়া-প্রতিবেশীও তাঁদের সাফল্যে নির্বিকার, উদ্যাপন করে না ওঁদের সাফল্য। সমাদর মেলে না বন্ধুদের কাছেও। নিভে যায় খেলার মাধ্যমে আত্মপরিচয় তৈরির ইচ্ছা। ফুটবল যে নারী ক্ষমতায়নের একটা শক্তপোক্ত উপায়, বিশ্বের নানা দেশে তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। অথচ আমাদের দেশে এখনো জনমানসে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে উদাসীনতা স্পষ্ট। তার সঙ্গে আছে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ, সাংস্কৃতিক টানাপড়েন।
এ দেশে ফুটবল ও মেয়েদের সংযোগের প্রতিকূল পরিবেশ বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা হয় নানাভাবে। দেশী ক্লাব ও অন্যান্য কয়েকটি সংস্থা দেশে অনেক ফুটবল অ্যাকাডেমি তৈরি করছে। কিছু ভালো ফুটবলার নিশ্চিত ভাবেই তৈরি হবে, মেয়েদের ফুটবল আধুনিক হবে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু এই সকল সরকারি-বেসরকারি অ্যাকাডেমিগুলোতে আবাসিকদের বার্ষিক ভরণপোষণের খরচ মধ্যবিত্ত পরিবারের সামর্থ্যরে বাইরে। সারাদেশে প্রান্তিক নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই ফুটবলের ‘সাপ্লাই লাইন’ টিকিয়ে রেখেছে। তাই এই অ্যাকাডেমিগুলোর রমরমায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সম্ভাবনাময় দরিদ্র মেয়েরা। এ ক্ষেত্রে সরকারি অনুদান, বৃত্তি, সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি খুব জরুরি। তেমন উদ্যোগ বিরল। ফলত নারী ক্ষমতায়নের যুদ্ধে ‘ফুটবল’ নামক অস্ত্রটি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ফুটবলের মাধ্যমে প্রান্তিক মেঠো মেয়েদের অন্তত পারিবারিক স্তরে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার যে ন্যূনতম সুযোগ তৈরি হতে পারত, তা ক্রমশ চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। জাতীয় ও আঞ্চলিক স্তরে অনেক মহিলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন হচ্ছে। সেখানে যত নামের পরিবর্তন ঘটেছে, মানের তত নয়। আসলে এই প্রতিযোগিতাগুলো সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক ক্রীড়া নীতি অনুসরণ করে না। হয়তো এতে খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত এক শ্রেণির মানুষের কিছু স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে, নাম বা প্রতাপ বাড়ছে, কিন্তু খেলোয়াড় মেয়েদের শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে না। সরকারি উদ্যোগ ছাড়াও দেশের নানা জায়গায় মেয়েদের ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়, সেগুলো প্রকৃত প্রস্তাবে ‘খেপ খেলা’ ছাড়া আর কিছু নয়।
মেয়েদের সম্ভাবনার অপব্যবহার করে এক দল মধ্যস্বত্বভোগী মানুষ আখের গোছাচ্ছে। যোগদানকারী দলসংখ্যা যা-ই হোক, দিনরাত রোদে পুড়ে পানিতে ভিজে এক থেকে দু’দিনে শেষ করা হয় প্রতিযোগিতা। ছোট্ট মাঠে ‘সেভেন আ সাইড’ খেলা চলে মিনিট পনেরো, পাঁচ মিনিটের বিরতি শেষে শুরু দ্বিতীয়ার্ধের খেলা। নিংড়ে নেওয়া হয় ফুটবলারদের শারীরিক সক্ষমতা। একটা টুর্নামেন্ট শেষে নতুন টুর্নামেন্ট শুরুর আগে দেওয়া হয় না ‘রিকভারি’ বা প্রস্তুতির সুযোগও। এ ভাবে খেলার মূল্যায়ন হয় না। ফলে বড় দলে খেলার সুযোগ পায় না এই মেয়েরা। অল্পেই নষ্ট হয় তাদের ফুটবল-দক্ষতা। মেয়েদের ফুটবল বলেই কি আয়োজন ও মানে এত অবহেলা! কিন্তু লাভের গুড় ঠিকই খেয়ে যায় এজেন্টরা। বাঙালির কাছে ফুটবল একটা ঐতিহ্য, কিন্তু মেয়েদের ফুটবল কোনো কালেই ‘জাতে’ উঠতে পারল না। অনাদরের এই আর্থ-সামাজিক পরিসরে একুশ শতকে আমাদের ক্রীড়া-সংস্কৃতি হয়ে উঠছে নারী-অবহেলার প্রতীক। ক্ষুধা, ক্লান্তি, আঘাতের বোধ ছাপিয়ে নারীত্বের শরীরি যন্ত্রণা কোনো পুরুষ ক্রীড়াবিদকে ভোগ করতে হয় না। নারী খেলোয়াড়দের তা পীড়া দেয় প্রতি পদে পদে। পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য রুখে মেয়েদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার অবলম্বন হয়ে উঠতে পারে ফুটবল তাই মাঝমাঠে নারীদের দৌড় যেন না থামে তা দেখতে হবে সর্বাগ্রে। মেয়েদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা এবং সহযোগিতা সুরক্ষা দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে তাদের। এতে এগিয়ে যাবে দেশ। মেয়েদের গর্বে গর্বিত হবে দেশের আপামর জনতা।
বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম থেকে