রাজস্ব ঘাটতি দুর্বলতা হঠাৎ কোনো বিষয় নয়, এটা বহু বছরের। এই দুর্বলতার ধারাবাহিকতা আমরা প্রতিবছর অবলোকন করি। আমাদের রাজস্ব খাতের মূল দুর্বলতা হচ্ছে রাজস্ব আইন। যদিও নতুন দুটি আইন গত বছর এসেছে। তবে সেগুলো কতটা বাস্তবধর্মী, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সহায়ক, করদাতাদের জন্য সহায়ক সেটা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। ফলে, নতুন আইনগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এটা একটা ভালো দিক যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়কর আইন, ২০২৩ পুনর্মূল্যায়ন করবে বলেছে। কাস্টমস আইন, ২০২৩ এবং আয়কর আইন কতটা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং করদাতাদের জন্য সহায়ক, সেটা ভেবে দেখার বিষয় আছে। আর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ সংস্কার খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালে খুব সুন্দর এ আইনটি খোঁড়া করে দেওয়া হয়েছে। তাই খুব ভালোভাবে এটির আধুনিকীকরণ করতে হবে।
আমাদের দেশে কর দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা রয়েই গেছে। কর বিভাগের ঐচ্ছিক ক্ষমতা অনেক বেশি। ফলে, করদাতা পরিস্থিতি যা তুলে ধরেন আর কর অফিসার যা পরিমাপ করেন, তার মধ্যে অনেক পার্থক্য থেকে যায়। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা অনেক বিভ্রান্তি এবং ভোগান্তিতে পড়েন। সুতরাং, ঐচ্ছিক ক্ষমতায় স্বচ্ছতা আনয়ন অনেক জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সহজ করার চেষ্টা করছে। ডিজিটালাইজেশন কিছু হয়েছে, সব নয়। যেমন ভ্যাট, আয়কর ইত্যাদিতে হয়েছে, কিন্তু কাজে দিচ্ছে না। কাস্টমসে কিছু ভালো পরিকল্পনা আছে। যেমন- ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিউ), যা বাস্তবায়ন করতে হবে। সার্বিকভাবে কর নেওয়ার যে কৌশল সেটি দেশের অর্থনৈতিক কৌশল, বিনিয়োগ কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। রাতারাতি কর বেড়ে যাবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। রাজস্ব আহরণ বহুদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। তবে এখনই সময় এটি সংস্কার করার। সরকার ভালো কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, রাজস্ব খাত সংস্কারে কমিটি করা হয়েছে। আমরা মনে করি এনবিআরের নতুন নেতৃত্ব অনেক বেশি সংস্কারমনা। তবে সমন্বিতভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রথমত, যেখানে গরমিল বা হেরফের হয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে ফরেনসিক অডিটের মাধ্যমে। এরপর সমাধান করে সঠিক উপাত্ত প্রকাশ করতে হবে। আমাদের ভিত্তিতেই সমস্যা, তাহলে আমরা তুলনা কীভাবে করব? তাই আগের হিসাবও ঠিক করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এটা কেন হয়েছে সেটা খুঁজে বেড় করতে হবে যদিও আমরা জানি যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এজন্য দায়ী। কিন্তু প্রক্রিয়াটি খুঁজে বের করে সেটির যেন পুনরাবৃত্তি না হয় এবং যারা এজন্য দায়ী, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কর দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা রয়েই গেছে। কর বিভাগের ঐচ্ছিক ক্ষমতা অনেক বেশি। ফলে, করদাতা যা পরিস্থিতি তুলে ধরেন আর কর অফিসার যা পরিমাপ করেন, তার মধ্যে অনেক পার্থক্য থেকে যায়। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা অনেক বিভ্রান্তি এবং ভোগান্তিতে পড়েন। তৃতীয়ত, পরিসংখ্যান সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীন এবং স্বচ্ছ করতে হবে। নিরপেক্ষ যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ রাখা দরকার। জাতীয় পরিসংখ্যান যেমন- জিডিপি, রপ্তানি, কমসংস্থান, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি প্রকাশের আগে প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ রাখা উচিত। সেটা বিশেষজ্ঞ, বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি, উন্নয়ন অংশীদারদের নিয়ে একটা প্যানেল হতে পারে। ফলে, সরকারি তথ্য কারও ফোনে পরিবর্তন হবে না।
শেয়ারবাজারকে শেয়ারবাজার হিসেবে না দেখে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হিসেবে দেখতে হবে। সেই অনুযায়ী আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের সুযোগ খুবই সীমাবদ্ধ, প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু এটা ছাড়া আমরা আগামী দিনের প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে পারব না। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন দাঁড় করাতে গেলে সেটার একটা অংশ হচ্ছে শেয়ারবাজার। এটাকে একটা শক্তিশালী ধারায় আনতে হবে, আরও বেশি কোম্পানি যাতে লিস্টেট হয়, বিনিয়োগ বাড়তে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দিতে হবে। সেই জায়গায় মূলধনী মুনাফার কর কমানোর বিষয়টি আমি মনে করি লিস্টেট কোম্পানি, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে কাজে লাগবে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত আমানত তুলে ফেলার হিড়িক ছিল। দুর্বল ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তো আমানত তুলতেই পারছে না। আবার ভালো ব্যাংকগুলোতে কিন্তু আমানত ফেরত আসছে। মূলত ১০-১১টি দুর্বল ব্যাংকে তাদের আগের মালিকরা রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় পেয়ে বা সমর্থন নিয়ে লুট করেছে। নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে পাচার করেছে। ফলে, এসব ব্যাংকের ৭০-৮০ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। লোন ফেরত না এলে ব্যাংকের আয় হচ্ছে না, আবার আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। ফলে, সেসব ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা টাকা তুলতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি কমাতে আরও কিছুদিন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সেসব দুর্বল ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিচ্ছে। তবে এটা খুব স্বল্প সময়ের জন্য হওয়া উচিত। এটা ১-২ বারের বেশি দেওয়া উচিত নয়। কারণ, এই তারল্য সহায়তা দিয়ে খারাপ ব্যাংক বাঁচানো সম্ভব নয়। একদিকে ফৌজদারি মামলা তদন্ত করতে হবে। তবে এই ব্যাংকগুলোকে পুনরায় দাঁড় করাতে হলে প্রথমে অলিগার্কদের থেকে মুক্ত করতে হবে, যা করা হচ্ছে। এরপর এই ব্যাংকগুলো দাঁড়াতে পারবে কি না তার একটা মূল্যায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সহায়তা দিয়ে একটা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা করতে হবে। কতটুকু সময়ের মধ্যে কী কী কাজ করে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারবে, নিজেদের কার্যক্রম চালাতে পারবে, আয় টেকসই করতে পারবে- সেই পরিকল্পনা করতে হবে। এই পরিকল্পনার একটা সময়সীমা থাকবে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ মনিটরিং থাকবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে যে সমর্থন দেওয়া উচিত সেগুলো দিয়ে যাবে।
তবে দু’একটা ব্যাংক হয়তো কোনোভাবেই দাঁড় করানো সম্ভব হবে না। সেগুলোর বিষয়ে এখনই কোনো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ বা অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেই প্রক্রিয়া এখন থেকেই শুরু করতে হবে। কারণ, এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। সেখানে হয়তো বন্ড ছেড়ে বা শেয়ারবাজারে লিস্টেট হয়ে নতুন টাকা ওঠানোর ব্যবস্থা থাকবে, যেন ব্যাংকগুলো পুনরায় তারল্য পায়, যা তাদের পরিকল্পনায় থাকবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো গ্যারান্টি বা রিস্ক শেয়ারিং সুবিধা দিতে পারে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, যা আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। ডিজিটাল ইকোনমি সেক্টরকে গ্রো (সম্প্রসারণ) করার ক্ষেত্রে আমরা অনেক লিক সার্ভিস দেখেছি, কিন্তু সত্যিকারের কাজ দেখিনি। এটা এতদিন হয়নি। এখনকার পৃথিবীটাই চলছে ডিজিটাল বাণিজ্যের মাধ্যমে। ইন্দোনেশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের সব উন্নয়নশীল দেশে এটি অনেক আগেই শুরু হয়েছে। আগামী দুই দশকে অর্থনীতিতে অন্য যে কোনো মাধ্যমের চেয়ে ডিজিটাল মাধ্যমের অবদান অনেক বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি অবশ্যই ডিজিটাল বাণিজ্যে যেতে হবে, নয়তো আমরা ১৮ কোটি মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারব না। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে আগামী দিনে ডিজিটাল বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে আমরা যদি ডিজিটাল রপ্তানি করতে না পারি, তাহলে রপ্তানি বহুমুখী করার সুযোগ হারাব।
আমাদের ডিজিটাল সেবা রপ্তানি বাড়াতে হবে। এজন্য আমদানিও বাড়াতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি যেমন- বিভিন্ন সফটওয়্যার, ক্লাউড সার্ভিস, ইত্যাদি আমদানি বাড়বে। ফলে, আগামী দিনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের এই নীতিমালা প্রয়োজন। নানা কারণে এখন ব্যবসায়ী, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা এবং আস্থার অভাব সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে নজর দিয়ে আস্থা ফেরাতে হবে, অনিশ্চয়তা সম্পূর্ণভাবে দূর করতে হবে। ব্যাংক খাতে কিছু ভালো উদ্যোগ এসেছে। একই উদ্যোগ রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে দিতে হবে। বিনিয়োগ, বাণিজ্যের সক্ষমতা সংক্রান্ত সংস্কার দ্রুত শুরু করা উচিত। তবে আশার বিষয় হলো যে, বর্তমান সরকার আর্থিক দুর্বলতার দিকগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান- ন্যশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন