বাড়ানো দরকার চালের সংগ্রহ
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উৎপাদনে মন্থর গতি, আমদানি হ্রাস ও সরবরাহ চেইনে বিপত্তি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। সাধারণত ২০ থেকে ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা অবহিত ছিলাম। এখন তা বেড়ে ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার যৌথ পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ৭ নভেম্বর প্রকাশিত ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের ২ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ বর্তমানে উচ্চমাত্রার খাদ্য সংকটের মাঝে দিনাতিপাত করছে। এদের বেশিরভাগ বাস করে সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর ও খুলনা বিভাগে।
চলতি ২০২৪ সালের গোড়ার দিক থেকেই বাংলাদেশের খেটে খাওয়া গরিব মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ব্যয় বেড়েছে। প্রবাসী আয় হ্রাস, রপ্তানির ধীর গতি ও আমদানি খরচ বৃদ্ধির কারণে দ্রুত হ্রাস পেয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তাতে আশঙ্কাজনকভাবে অবচয়ন ঘটেছে বাংলাদেশী মুদ্রার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এপ্রিল-মে মাসে দেশের সর্বত্র অনুভূত হয়েছে তীব্র তাপপ্রবাহ ও খরা। তারপর ঘূর্ণিঝড় রেমাল, হাওড়ে বন্যা, দক্ষিণ-পূর্বঞ্চলে আকস্মিক বন্যা এবং পরে ময়মনসিংহ ও শেরপুরসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে দারুণভাবে বিঘিœত হয়েছে কৃষির উৎপাদন।
অপরদিকে ডলার সংকট ও এলসি খোলার জটিলতায় হ্রাস পেয়েছে খাদ্যপণ্যের আমদানি। তদুপরি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পণ্যের সরবরাহ চেইন। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যমূল্যস্ফীতি। বৈশি^ক অর্থনৈতিক সংকট ও সংঘাতের কারণে এ সমস্যা তীব্র হয়েছে। তাতে ভোগান্তি বেড়েছে নি¤œ ও নির্দিষ্ট আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের। বেড়েছে তাদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। এটি মানুষের জীবনমান কমে যাওয়ার অশনি সংকেত।
গত অক্টোবর মাসে দেশে খাদ্যমূল্যস্ফীতির পরিমাণ ছিল ১২.৬৬ শতাংশ। এটি পয়েন্ট টু পয়েন্ট গণনার ভিত্তিতে। অর্থাৎ গত বছর অক্টোবরে যে খাদ্যপণ্যের মূল্য ছিল ১০০ টাকা এবার অক্টোবরে তা ভোক্তাদের ক্রয় করতে হয়েছে ১১২ টাকা ৬৬ পয়সায়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে খাদ্যমূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২.৫৬ শতাংশ। ২০২২ সালের অক্টোবরে ছিল ৮.৫ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের একটি উচ্চ ভিত্তি থেকে দ্রুত বেড়ে চলছে দেশের খাদ্যমূল্যস্ফীতি। এবারের খাদ্যমূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বেশি প্রভাব রেখেছে চাল, সবজি, ডিম, মুরগি ও পেঁয়াজের দ্রুত মূল্যবৃদ্ধি। নিকট অতীতে, বিশেষ করে সবজি ও ডিমের বাজারে এত বেশি অরাজক পরিস্থিতি আর কখনো পরিলক্ষিত হয়নি।
এরূপ মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ সরবরাহ সংকট। দ্বিতীয়ত উৎপাদনের উপকরণ মূল্যতাড়িত উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি। তৃতীয়ত সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও অর্থনৈতিক মুনাফা অর্জনের হীন প্রচেষ্টা। বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কালে গত কয়েকমাস ধরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৯ এবং খাদ্যমূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে। এমতাবস্থায় গত অক্টোবরের লাফিয়ে খাদ্যমূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ আশি^ন-কার্তিক মাসের অনেকটা নিস্ফলা ক্রান্তিকাল। এ সময় বাজারে সরকারি পর্যবেক্ষণ ও হস্তক্ষেপ খুবই বেশি প্রয়েজন হয়, যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা একচেটিয়াভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোনো সফলতা আমরা দেখতে পাইনি। ফলে এর মাশুল দিয়েছে দেশের গরিব ভোক্তাগণ।
দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কম হলে বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার অন্যতম উপায় হচ্ছে আমদানি বৃদ্ধি করা। কিন্তু ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং এলসির ক্ষেত্রে ব্যাংক সুবিধা সংকোচনের ফলে খাদ্যপণ্য আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য বেশি হওয়াও আমদানি হ্রাসের অন্যতম কারণ। গত দু’বছরে ক্রমাগতভাবে আমাদের কৃষিপণ্যের আমদানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে, যে কারণে বাজারে সরবরাহ সংকটজনিত মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এবার আশি^ন-কার্তিক মাসে এই সংকট যে খুবই কঠিন হবে তা আগেই অনুমান করা গিয়েছিল।
কিন্তু সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। অতি সম্প্রতি বিভিন্ন পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস করে কিছু পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পরেই আমন চালে বাজার ভরে যাবে। নতুন আলু ও পেঁয়াজ উঠবে বাজারে। এমতাবস্থায় বিলম্বে আমদানি উৎসাহিত করে প্রকারান্তরে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত কৃষকদেরকেই নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদের এই সময়জ্ঞান সম্পর্কে উদাসীনতা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। গত ৩১ অক্টোবর চাল আমদানির শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে, যাতে আমদানি বৃদ্ধি পায়।
নভেম্বরের মধ্যভাগ থেকে আমাদের দেশেই আমন ধান সংগ্রহ শুরু হয়। বর্তমানে সরকারি গুদামে চাল মজুদের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টন। আমন ধান কাটার আগ মুহূর্তে সরকারি গুদামে এত বেশি চালের মজুদ ধরে রাখার কোনো প্রয়োজন আছে কি? সর্বোচ্চ ২/৩ লাখ টন চাল মজুদ রেখে বাকি চাল এখনই খোলাবাজারে ছেড়ে দেয়া উচিত। তাতে কোনো আমদানি ছাড়াই প্রাক উৎপাদন মৌসুমের উচ্চমূল্য অবদমিত করা সম্ভব হবে।
সরকারের আমন ধান ও চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে ১৭ নভেম্বর থেকে। চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আতপ চাল সংগ্রহ করা হবে ১৫ মার্চ পর্যন্ত। এবার ধান সংগ্রহ করা হবে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন। সিদ্ধ চাল ৫ লাখ ৫০ হাজার টন ও আতপ চাল ১ লাখ টন। মোট সংগ্রহ ১০ লাখ টন। ধানকে চাল হিসেবে বিবেচনায় ধরে মোট চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হলো ৮ লাখ ৮০ হাজার টন। সম্ভাব্য মোট চাল উৎপাদনের প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ধান ৩৩ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৭ টাকা এবং আতপ চাল ৪৬ টাকা। এই দাম উৎপাদন খরচের প্রায় সমান। এই দামে সরকারি গুদামে ধান-চাল সরবরাহ করার ক্ষেত্রে উৎপাদকদের উৎসাহ থাকে কম।
বিশেষ করে গুদামে ধান প্রদানের ক্ষেত্রে কৃষকদের আগ্রহ থাকে না বললেই চলে। এ কারণে গত ৩/৪ বছর ধরে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকও অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকার নির্ধারিত মূল্যের অনেক কম দামে কৃষকরা খামার প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীদের কাছে ধান বিক্রি করে দিচ্ছে। উপজেলা শহরের খাদ্য গুদামে গিয়ে তারা ধান বিক্রির ধকল পোহাতে চায় না। এক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তনীয় আর্দ্রতায় পরিবর্তনশীল মূল্যে কৃষকের খামার প্রান্ত থেকে ধান সংগ্রহ করতে পারে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের প্রতি টন মূল্য ৪১০ থেকে ৫২০ ডলার।
বাংলাদেশে এর প্রতি কেজি আমদানি খরচ পড়ে ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। তারচেয়ে অনেক কম দামে আরও বেশি পরিমাণে চাল অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করা হলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন তাদের উচিত দেশের কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনা করা। আমাদের মোট উৎপাদনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ চাল সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হলেও চলতি আমন মৌসুমে মোট চাল সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৫ লাখ টন। তাতে উৎপাদন মৌসুমে চালের দাম পড়ে যাওয়া এবং নিষ্ফল সময়ে মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ কার্যকরভাবে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রাজ্যভেদে কৃষিপণ্যের সরকারি সংগ্রহের পরিমাণ হচ্ছে মোট উৎপাদনের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। উৎপাদন খরচের ওপর তারা ২০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা যোগ করে সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করে থাকে। কৃষকদের দাবি ৫০ শতাংশ।
দেশের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য মজুত সম্পর্কে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর যথাসময়ে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান সরবরাহ করা উচিত। এক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতার ঘাটতি আছে। উদাহরণস্বরূপ চালের মোট উৎপাদনের কথা বলা যায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চালের মোট উৎপাদন ধরা হয়েছে ৪ কোটি সাড়ে ৭ লাখ টন। তাতে ডিসেম্বর পর্যন্ত চালের সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা ছিল না। কিন্তু বাস্তবে তাই হয়েছে। তাতে সরকার প্রদত্ত পরিসংখ্যান সম্পর্কে মানুষের সন্দেহ জেগেছে। অনেকে মনে করেন এ পরিসংখ্যান অতিমূল্যায়িত, স্ফীত।
অপরদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বিভাগ কৃষি উৎপাদনের হালনাগাদ তথ্য দিতে প্রায়ই বেশি সময়ক্ষেপণ করে থাকে। যেমন গত মে মাসে আমাদের বোরো ধান উৎপাদনের কাজ শেষ হয়েছে। তার পরিসংখ্যান এসেছে গত সেপ্টেম্বরের শেষ প্রান্তে। বলা হচ্ছে গত বছর আলুর উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৩ লাখ টন। ব্যবসায়ীরা বলছেন সর্বোচ্চ ৮০ লাখ টন। কোল্ড স্টোরেজসমূহে অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ আলু সংরক্ষণ ও বাজারে এর অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারি সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত আলু উৎপাদনের পরিসংখ্যান সঠিক বলে অনেকে মেনে নিচ্ছে না। বর্তমানে দেশে মোট আলুর চাহিদা ৮০ থেকে ৯০ লাখ টন। তাতে আলুর উদ্বৃত্ত ১০ লাখ টনেরও বেশি হওয়ার কথা।
অথচ আমরা আলু আমদানির ওপর নির্ভর করছি মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য। শস্য বহির্ভূত কৃষি খাতেও উৎপাদনের পরিসংখ্যান অতিরঞ্জিত, বেশি প্রদর্শিত। দুধ, ডিম, মাংস ও মাছের উৎপাদন এবং জনপ্রতি প্রাপ্যতা যা দেখানো হচ্ছে সরকারের এইচআইইএস সার্ভে থেকে প্রাপ্ত ভোগের ক্ষেত্রে তার অর্ধেকও প্রতিফলিত নয়। তাহলে বাকি উৎপাদন যায় কোথায়? কেন এত মূল্যবৃদ্ধি? কৃষি উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরূপ পরিসংখ্যানগত অতি মূল্যায়ন বাজার স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। তাতে উপযুক্ত সময়ে যথাযথ হস্তক্ষেপের নীতিমালা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা হ্রাস করতে হলে প্রথমত এর জনপ্রতি প্রাপ্যতা বাড়াতে হবে। এর প্রধান উপায় উৎপাদন বৃদ্ধি করা। মূল্যস্ফীতি কমানো। প্রতি ইউনিট উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন খরচ কমে আসবে। তাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতির ওপর। ইতোমধ্যে সরকার দেশের মুদ্রা ও রাজস্ব নীতিতে বেশকিছু পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। সরকারি খরচ আঁটসাঁট করছে। মুদ্রা সরবরাহ সংকুচিত করা হয়েছে। দুর্নীতিকে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংকিং খাতের সংস্কার করা হচ্ছে। অর্থ পাচার রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয় বৃদ্ধি পেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে যাবে। তাতে টাকার অবচয়ন রোধ হবে। এক সময় আমাদের মুদ্রার মানও বেড়ে যাবে। ফলে সাধারণ মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। এর সঙ্গে মানুষের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অভিগম্যতা বৃদ্ধি পাবে।
খাদ্যের প্রাপ্যতা ও অভিগম্যতা নিশ্চিত করার সঙ্গে খাদ্য বিতরণে বৈষম্য দূর করতে হবে। বর্তমানে আমাদের আয় ও সম্পদের বৈষম্য প্রকট। সে কারণে খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও বড় বৈষম্য বিরাজমান। এ বৈষম্য ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আছে। লিঙ্গভেদে বৈষম্য আছে। আছে আঞ্চলিক বৈষম্য। অর্থ উপার্জনের সুযোগের মধ্যেও বৈষম্য আছে। এগুলো দূর করতে হবে। স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য সহায়তা বাড়াতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও অর্থায়নের মাধ্যমে আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব।
তাছাড়া সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে শিক্ষা, চিকিৎসা তথা মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস করতে হবে। গত জুলাই-আগস্ট মাসে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যকে কেন্দ্র করে যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল তার সুফল সমাজ ও অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে পৌঁছে দিতে হবে। এর জন্য রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন। মানুষের স্বাধীনতা, সাম্য ও উন্নত জীবনের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো প্রয়োজন।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বৈষম্যের শিকার গ্রামের মানুষ। এদের মধ্যে বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছে কৃষক। তারা পরিশ্রম করে বেশি, প্রতিদান পায় কম। কৃষি কাজে তাদের খরচ বেশি, মুনাফা কম। মূল্যস্ফীতির চাপও এখন গ্রামেই বেশি। তাতে নাকাল অবস্থায় কৃষক। তাদের চিকিৎসার অভাব, শিক্ষার অভাব। মাঠে তাদের সাপে কামড়ায়, বজ্রপাতেও তারা মারা যায়; কিন্তু তার কোনো প্রতিবিধান সচরাচর হয় না। সরকারি সাহায্য-সহায়তার ক্ষেত্রেও এদের হিস্যা কম। বাংলাদেশের একজন কৃষক বছরে কৃষি উপকরণ ভর্তুকি পায় মাত্র ৯০০ টাকা। চীনে এর পরিমাণ ২০ হাজার টাকা। ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও বলিভিয়াতেও কৃষকপ্রতি ভর্তুকির পরিমাণ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।
দেশের সরকার ধান কেনে প্রতি কেজি ৩৩ টাকায়, সন্দ্বীপের ধানভা-ার বলে খ্যাত সবুজ চরের চাষিরা পায় মাত্র ২০ টাকা। এই বঞ্চনার কথা সকলেরই অনুধাবন করা দরকার। বৈষম্যবিরোধী নীতিমালা প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা দরকার আমাদের গরিব ও নিরীহ কৃষকদের। তাতে স্বস্তি পাবে কৃষক। উৎপাদনে তারা উৎসাহিত হবে। দেশে মোট খাদ্যশস্যর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ফলে দ্রুত হ্রাস পাবে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি
অব গ্লোবাল ভিলেজ