শিক্ষা একটি জাতির উন্নতির প্রধান মাপকাঠি। বলা হয় যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। শিক্ষার সর্বোচ্চ স্থর হচ্ছে উচ্চ শিক্ষা। প্রতিনিয়ত উচ্চ শিক্ষার নিমিত্তে বাংলাদেশ হতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমায়। যাদের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে দেশে ফিরে আসে না। বরং ঐ দেশে স্থায়ী হয়ে যায়।
বিষয়টি বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য শঙ্কার। মেধাবীদের দেশ ত্যাগ একটি জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে পারে। যদিও ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সা.) জ্ঞান অর্জনের উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলেছেন " জ্ঞান অন্বেষণের জন্য প্রয়োজনে সূদুর চীন দেশে যাও"। চীন শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়ছে। মূলত জ্ঞান অর্জনের উপর গুরুত্ব দিতে উক্তিটি করা হয়েছে।
প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার অজুহাতে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। মেধাবীদের উচ্চ শিক্ষার নিমিত্তে দেশ ত্যাগের বিষয়টি পূর্বে গাণিতিক হারে বাড়লেও বর্তমানে তা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর প্রবণতা অনেকাংশে বেশি।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেকারক্ত, দারিদ্রতা, কর্মসংস্থান সংকট, ভঙ্গুর গণতন্ত্র, স্বৈরাচারী শাসন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রতি, উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশের অভাব প্রভৃতি কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। তাছাড়া দেশে মেধার যথাযর্থ মূল্যায়ন না হওয়া, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরী পাওয়া যায় না, এই সমস্ত অজুহাতে প্রতিনিয়ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশ ছাড়ছে।
প্রতিবছর প্রায় অর্ধলক্ষ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করছে। যাদের মধ্যে শতকরা ৮০ শতাংশ ঐ দেশে স্থায়ী হয়ে যায়। এতে দেশে মেধা শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ইউরোপ- আমেরিকা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মত উন্নত দেশগুলো।
এসব দেশগুলো কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, উন্নত জীবনযাত্রা ও আধুনিক সুযোগ সুবিধা তৈরি করে মেধাবীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। অনেক দেশ মেধাবীদের জন্য ১০০ শতাংশ পর্যন্ত স্কলারশিপ প্রদান করে থাকে। এভাবে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী উন্নত জীবনের মোহে আকৃষ্ট হয়ে উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমাচ্ছে।
একসময় দাস ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তখন মানুষ মানুষের দাস হিসেবে গণ্য হত। ইউরোপীয় বণিকরা এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে দাস সংগ্রহ করে ইউরোপ - আমেরিকার বাজারে পাচার করত। দাস ব্যবস্থার শেষ দিকে ইউরোপীয় সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সারাবিশ্বে কলোনি গড়ে তুলে। নিজের অধীনে থাকা কলোনিগুলো থেকে স্বল্পমূল্য কাঁচামাল আমদানি পরবর্তীতে সে দেশেই রপ্তানি করত।
সম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো কলোনিগুলো থেকে বিপুল পরিমান সম্পদ পাঁচার করে নিজেদের দেশকে গড়ে তুলে। এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে শোষণ করে আজকের আধুনিক ইউরোপ আমেরিকার ভিত্তি স্থাপিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একে একে সবগুলো কলোনি স্বাধীনতা লাভ করে।
বর্তমানে আমরা আধুনিক যুগে বসবাস করছি। জ্ঞান - বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মহাকাশবিদ্যা সর্বত্র উন্নতির স্বর্ণ শিহরণে আরোহন করছি। এর পিছনে মেধার ভ‚মিকার অনস্বীকার্য। পূর্বে অর্থ - সম্পদ পাচার হলেও বর্তমানে মেধা পাচারের বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো নানা সুযোগ সুবিধার প্রলোভন দেখি মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য ফাঁদ পেতে রাখে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা উন্নত জীবনের মোহে পড়ে সেই ফাঁদে পা দেয়।
একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে তৈরি করতে রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে বই, উপবৃত্তি, ভুতুর্কি, বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র মূল্যে অধ্যায়নের সুযোগ সুবিধা, শিক্ষক - কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন -ভাতা সহ প্রভৃতি খাতে রাষ্ট্র বিনিয়োগ করে থাকে। রাষ্ট্রের সেবা করাই এর মূল লক্ষ্য। কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুরের মাথার ঘাম পায়ে পড়া অর্থে বিদ্যার্জন করে দেশের কথা না ভেবে শুধু নিজের উজ্জ্বল ভবিষতের জন্য ভিনদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
ফলস্বরুপ দেশে মেধার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। মেধাবীদের দেশত্যাগ একটি দেশকে মেরুদন্ডহীন বানিয়ে দিতে পারে। আজকের অফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহারণ। মহাদেশটিতে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যতা থাকলেও শিক্ষিত - দক্ষ মানব সম্পদের অভাবে তা কাজে লাগাতে পারছেনা। বিপরীতে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো তৃতীয় বিশ্ব থেকে মেধা পাচার করে জ্ঞান বিজ্ঞানের শীর্ষে আরোহণ করছে।
আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা, অ্যাপল, মাইক্রোসফট, গুগলের মত টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল বিশ্বের মেধাবীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। যদিও এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হলেও সর্বোপরি রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মেধাবীরা একটি রাষ্ট্রের প্রাণভ্রমরা। বর্তমান বিশ্ব মেধার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বলা হয় যে, "একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে চাইলে, আগে ঐ দেশের বুদ্ধিজীবী - মেধাবীদের ধ্বংস করে দাও।" ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর নিজেদের নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদেশের মেধাবীদের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া। মেধা পাচার রুখতে না পারলে দেশ অচিরেই পঙ্গুত্ব বরণ করবে।
এর জন্য প্রয়োজন মেধার যথাযর্থ মূল্যায়ন নিশ্চিত করা। কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকারক্ত সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে সরকারের উচিত দেশের সর্বত্র আধুনিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলা। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে হবে।
দুর্নীতি -স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি সমস্যাগুলো হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকেও উচিত আত্মচিন্তায় মগ্ন না থেকে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা। সর্বোপরি দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায়, মেধা পাচার রোধ করা আদৌ সম্ভব নয়।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়