সভ্যতার রূপান্তর ঘটে প্রযুক্তির আবির্ভাবে। আগুনের ব্যবহার সর্ব প্রথম মানব জীবনে বড় ধরণের পরিবর্তন আনে, এর ধারাবহিকতাই চাকার আবিস্কার ইঞ্জিনের আবিস্কার বিদ্যুতের ব্যবহার ইত্যাদি মানবজীবনে ব্যাপক রূপান্তর আনতে সক্ষম হয়। এই উদ্ভাবন এতই যুগান্তকারী ও কার্যকর যে সারা বিশ্বে সেটা ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এখন প্রযুক্তির নতুন একটি ধারার সম্মুখীন হয়েছি যা হচ্ছে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
মেশিন লার্নিং, প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়া করণের মাধ্যমে শিল্পের বিভিন্ন ধারাকে এটি রুপান্তর করেছে। ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে এবং সামাজিক কাঠামোকে পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ করছে। মানুষের কাজের ধরণ, চিন্তাভাবনা, ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন এক যুগের দিকে আমরা অগ্রসর হচ্ছি।
এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো এমন একটি প্রযুক্তি যা মেশিনকে মানুষের মতো চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা তৈরী করে। সহজ ভাষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কম্পিউটার, রোবট ও বিভিন্ন ইলেট্রনিক্স ডিভাইসকে কিভাবে চিন্তা করতে হয় শেখায়।
এআই বিপ্লব বলতে, এই প্রযুক্তি আমাদের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে যে বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সেটাই ইঙ্গিত করে। মানুষের উৎপাদনের পদ্ধতিতে ব্যাপক ভাবে প্রভাব ফেলছে এআই।কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন খাতকে বদলে দিয়ে সম্ভাবনার এক বিরাট দুয়ার আমাদের সামনে উন্মুক্ত করেছে।
চিকিৎসা খাতের বিভিন্ন স্তরে এখন এআই ব্যবহার হচ্ছে। রোগ নির্ণয়ের জন্য বেশ কার্যকর এটি। ক্যান্সার সনাক্ত করণে এআই মানুষের চাইতে অধিক নির্ভুল ফলফল দিতে পারে। ক্যান্সার চিকিৎসায় এর ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে। তাছাড়া রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণে, রিপোর্ট প্রদান করে উপযুক্ত চিকিৎসা পরিকল্পনা তৈরী করতে চিকিৎসকদের সাহায্য করছে।
এমনকি বিভিন্ন এআই টুলের মাধ্যমে ঘরে বসে অনেক রোগের নির্ণয় করা সম্ভব। ঔষধ ও ভ্যাকসিন আবিষ্কারে ব্যবহৃত জটিল অ্যালগোরিদম অনেক দ্রæত ও নির্ভুল ভাবে ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি গুলো এআই দিয়ে সম্পন্ন করছে। ড্রাগ ইন্ড্রাস্টিতে বৈপ্লবিক ও পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে এআই।
শিক্ষাক্ষেত্রে এআই এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। বিশেষত ঘরে বসে বসেই শিক্ষা অর্জন করা এখন অনেক সহজ হয়েছে। কঠিন ম্যাথম্যাটিক্স থেকে দুর্বোধ্য কোডিং সব কিছুই এখন খুব সহজেই সমাধান করতে পারে এআই। এমনকি এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করাও সম্ভব। শিক্ষকগণ এর ব্যবহার করে ক্লাস পরিকল্পনা এবং শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
ভাষা শেখার ক্ষেত্রে এআই অনেক কার্যকরী। যেমন এআইবট এর সাথে সরাসরি বিদেশি ভাষার আলাপচারীতা করা যায়। এমনকি আলাপের মাঝখানে বিভিন্ন ভুলত্রæটি এআই ধরিয়ে দেয়। ডুয়োলিঙ্গো আ্যপ্লিকেশন ভাষা শিক্ষার জন্য সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গবেষণা খাতেও এআই বিশেষ ভ‚মিকা রাখছে।
শিল্প উৎপাদন ও অর্থনীতিতে এআই এর প্রভাব সবচাইতে বেশি। অটোমেশন এর মাধ্যমে কারখানায় কাজের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। চালক বিহীন গাড়ি তৈরীতে বিশ্বের বিভিন্ন অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে। ইলন মাস্কের টেসলা কোম্পানি টাইপ-৩ অটোনোমাস গাড়ি বিক্রি করছে। টাইপ-৪ প্রযুক্তিতে সফলতা আসলে আমরা বিশ্বে সর্বপ্রথম ড্রাইভার বিহীন গাড়ি দেখতে যাচ্ছি।
এআই এর মাধ্যমে ড্রোন প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটেছে। ড্রোনে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে লজিস্টিক খাতে বড় পরিবর্তন এসেছে। বিখ্যাত আ্যমাজন কোম্পানি এআই ড্রোনের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে পার্সেল ডেলিভারি করছে। চালক বিহীন বিমান তৈরীর স্বপ্নও মানুষ দেখছে।
আইটি খাতে এআই এর প্রভাব সবচাইতে বেশি। কোডিং, ডিজাইনিং এডিটিং ইত্যাদি কাজে মানুষের সৃজশীলতাকে বহু গুনে বাড়িয়ে তুলেছে এআই। আর্টিকেল রাইটিং, প্রোফেশনাল ইমেইল রাইটিং এছাড়া গান, কবিতা, গল্পের লেখার মত ক্রিয়েটিভ কাজও এআই করতে সক্ষম। চ্যাটজিপিটি, মিডজার্নির মত আ্যপ্লিকেশন সফটওয়্যার গুলো রাতারাতি বিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিজীবনেও এআই এর ব্যবহার বাড়ছে। ভার্চুয়াল চ্যাটবট এর মাধ্যমে ট্যাক্স, ইনস্যুরেন্স, ট্রেডিং ইত্যাদি বিভিন্ন সেবা কম খরচে ২৪ ঘন্টা "প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে।
সকল বিপ্লব অনেক সম্ভাবনা নিয়ে আসলেও কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরী করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমতা মানুষের কর্মসংস্থান হুমকি হয়ে দাড়াতে পারে। সিনেমা উপন্যাসে আমরা প্রায়শই দেখি কিভাবে প্রযুক্তি মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে অতিক্রম করে মানুষের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে। এক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই পথেই হাটছে বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন।
আমেরিকার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রায় ৫২ শতাংশ মানুষ এআইকে উপকারের থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে। এআই এর অটোমেশনের ফলে লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে মানুষের জন্য আরেকটি বড় রিস্ক হচ্ছে তথ্যের স্বচ্ছতা ও ত্রæটি যাচাই। উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে পক্ষপাত মূলক তথ্য উপস্থাপনা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হবে।
এআই এর মাধ্যমে আড়িপাতা ও গোপন তথ্য কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যায়। যেমন চিন ফেসিয়াল রিকগনিশন পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে মানুষে গতিবিধির উপর নজরদারি বাড়িয়েছে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী গুলো। এআই সমর অস্ত্রের আধুনিকীকরণ করে যুদ্ধের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি করতে পারে।
সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধিতে এই এআই সহায়ক হিসাবে কাজে লাগাতে পারে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী গুলো। মাদক, অস্ত্র, বিস্ফোরকের মত ক্ষতিকর দ্রব্যের ফর্মুলা দিতে সক্ষম এআই। সর্বোপরি মানুষের প্রভাব কমাতে সক্ষম এআইকে মানুষ বেশি ভয় পাচ্ছে।
সকল চ্যালেঞ্জ থাকা সত্তে¡ও এআই এর প্রয়োগ ও উপযোগিতা বাস্তবসমত। খুব স্বল্প সময়ে এর জনপ্রিয়তা বলে দিচ্ছে এআই বিপ্লব অনিবার্য। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে এআই। নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে প্রযুক্তির দুনিয়াতে। তাই এটি মানুষের সমাজ এবং জীবনযাত্রার কাঠামোগত পরিবর্তন করবে। নতুন একটি যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় হাত ধরে। তাই এর চ্যালেঞ্জ গুলো নিয়ে ও আমাদের ভাবতে হবে। এআই এর সঠিক ব্যাবহার করে ভবিষ্যৎ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়