ব্রহ্মপুত্র বাংলার এক প্রাচীনতম নদ, যার বুকজুড়ে ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবনের নানা অধ্যায়। এ নদের ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের অস্তিত্বের গল্প। কিন্তু আজ ব্রহ্মপুত্র যেন আর্তনাদ করছে, কারণ তার বুকে চলছে এক ভয়ংকর খেল—বালি উত্তোলন। এই অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন শুধু ব্রহ্মপুত্রের স্বাভাবিক প্রবাহকেই বাধাগ্রস্ত করছে না, বরং ধ্বংস করছে এর প্রাকৃতিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য।
নদ-নদী শুধু পানি প্রবাহের মাধ্যম নয়; এটি একটি সভ্যতার ভিত্তি। ব্রহ্মপুত্র তার দীর্ঘ যাত্রাপথে বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য, এবং মানুষের জীবনধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু বালি উত্তোলনের অমানবিক কর্মকাÐের ফলে এই নদ এখন প্রকৃত রূপ হারাচ্ছে।
একটি সময় ছিল যখন ব্রহ্মপুত্রের জল কৃষকের জমিতে সেচ দিত, নৌযানে বাণিজ্য চালিত হত, আর মাছ শিকারির জীবন বাঁচাত। অথচ এখন নদীর জল শুকিয়ে যাচ্ছে, তলদেশ ভরাট হচ্ছে। আর পানির গতিপথ পরিবর্তনের ফলে নদী অববাহিকার মানুষ ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ছে। ব্রহ্মপুত্রের বুকে যান্ত্রিকতার জগদ্দল প্রভাব তার গভীরতা কমিয়ে দিয়েছে। বালি উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। এই ক্ষত শুধু ব্রহ্মপুত্রের নয়, তার আশেপাশের মানুষের জীবনেরও।
প্রান্তিক কৃষকের জমি, জেলের মাছ ধরা জীবিকাÑ সবকিছুই আজ হুমকির মুখে। নদীর ধারের গ্রামগুলোতে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে, এবং এর ফলে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে।
ব্রহ্মপুত্রের এই অবস্থা কেবলই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, এটি মানুষের লোভের সরাসরি ফল। ক্ষমতা বদলের পালায় স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর অবাধ দাপটে নদী তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদের এই অনিয়ন্ত্রিত লুটপাট শুধু ব্রহ্মপুত্র নয়, পুরো দেশের পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী।
তারা নদীর বুকে মেশিন নামিয়ে বালি উত্তোলন শুরু করে, যা কেবল নিজেদের আর্থিক লাভের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। এই প্রক্রিয়া স্থানীয় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় চলে, যেখানে কোনো পরিবেশগত নীতিমালা মানা হয় না।
প্রশ্ন হলো, এই সংকটের সমাধানে স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের ভ‚মিকা কোথায়? নদীর ওপর নির্ভরশীল সাধারণ মানুষের কণ্ঠ কি তাদের কানে পৌঁছায় না? নদী তার স্বাভাবিক গতি হারালে কী ঘটে, তা আমরা অতীতে বহুবার দেখেছি। অতিরিক্ত বালি উত্তোলনের ফলে নদীর তীর দ্রæত ভেঙে পড়ে। এর ফলে নদীর পানি প্রবাহের চক্র অস্বাভাবিক হয়ে যায়।
ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় নদীর ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বন্যা, খরার মতো বিপর্যয়। এমনকি আমরা যান্ত্রিকতা দিয়ে প্রকৃতির ওপর আধিপত্য স্থাপন করতে গিয়ে বুঝতে পারি না, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিতেই পারে। এই প্রতিশোধ কখনও আসে ভাঙন হয়ে, কখনও বন্যা হয়ে,আবার কখনও ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর কমে গিয়ে। ব্রহ্মপুত্রের আহŸান শুনুন।
তার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাওয়া বন্ধ করুন। প্রকৃতি আমাদের অনেক দিয়েছে, কিন্তু আমরা প্রকৃতির শত্রæ হয়ে দাঁড়িয়েছি। এখনই সময়, এই যান্ত্রিক অত্যাচার থেকে সরে এসে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাঁচার। বালি উত্তোলন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে ব্রহ্মপুত্রকে রক্ষা করুন—এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
উলিপুর, কুড়িগ্রাম থেকে