ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

একটি উজ্জ্বল সংগীতসন্ধ্যা

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:০৪, ১৮ নভেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২০:৩১, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

একটি উজ্জ্বল সংগীতসন্ধ্যা

রবিবারের সকালটি আমরা ঘুমে কাটাতে পছন্দ করি। যারা মনে করেন বিদেশের জীবন মানে রঙিন তারা আসলে ভুলের ভেতর বসবাস করেন। এখানে পাঁচ কর্মদিবস কঠিন পরিশ্রমের পর দুদিন সবাই ঝাড়া হাত-পা। এই দুদিন বাড়ির কাজ আর বিশ্রাম। কিন্তু মাঝে মাঝে রবিবার আমাদের দাওয়াতে যেতে হয়। যেতে হয় নানা অনুষ্ঠানে। আমার এক প্রিয় বন্ধু নিকেশ, দীর্ঘদিনের বন্ধু। তার কোনো কথা আমি সহজে ফেলতে পারি না। তার আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম একটি ভিন্নধর্মী আয়োজনে।

বলাবাহুল্য এমন আয়োজন নতুন কিছু না। বিদেশের বাঙালি এ ধরনের বহু অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। সাধারণত: জটিল রোগ বা দেশের বন্যা দুর্যোগ মোকাবিলায় সমবেত হবে ফান্ড তোলার চেষ্টা চলছে চলবে অবিরাম। গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ভেদে এই আয়োজনগুলো এলাকাভিত্তিক-ই হয়। সে যাই হোক আমি গিয়ে দেখলাম পরিচিত সব মুখের ভেতর চিকিৎসকের সংখ্যাই বেশি। ক্যান্সার গবেষণায় পিএইচডি করা ড. লায়লা আর্জুমান্দকে আমি এর আগে দেখলেও তার কাজের এমন বিস্তৃতির কথা জানা ছিল না। তাদের সংগঠন উদয়। উদয় নামটিও দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ। ইংরেজিতে এই উদয় বা UDOY-এর ফুল ফর্ম Unity in Diversified Optimistic Youth। কর্কট রোগ হানা দেয়নি এমন পরিবার বিরল। আমি আমার পরিবারের একাধিক নিকটাত্মীয় হারিয়েছি এই রোগে। ক্যান্সার মানে শেষ বা আর কোনো ত্রাণ নাই পরিত্রাণ মিলবে না। এমন ধারণা ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে। সেদিনের সকালে প্রাতরাশ খাওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের মূল্যবান কথাগুলো মনে করিয়ে দিল আশা কখনো মরে না। জীবন একটাই। সেই জীবনকে সুন্দর আর সুস্থ রাখতে আমাদের পাশে আছেন অনেক উদার মনের মানুষজন।
এরা চাইলে সহায়তা দিতে পারেন। যা সমাজের জন্য রোগীর জন্য এমনকি রোগীর পরিবার পরিজনের জন্য জরুরি। লায়লাকে ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশের নানা দুর্যোগ আর দুঃসময়ে তাদের মতো অনেকেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন কর্মে। কাজ করার মানুষ বাঙালিদের ভেতর কম। অধিকাংশ আমার মতো কথাপাগল। তাই আমি কাজের মানুষদের সম্মান করি, শ্রদ্ধা জানাই। তারা কতদূর পারবেন বা কতদূর যাবেন সেটা সময় বলবে। কাজ যদি প্রবহমান থাকে তার একটা ফলাফল তো মিলবেই। ক্যান্সারের মতো ধ্বংসাত্মক ব্যাধি আর ভয় জাগানো রোগটির মোকাবিলায় বাংলাদেশী নারীর সাহসিকতা আর সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে আমি সাধুবাদ জানাই।
আমাদের দেশে অসংখ্য মানুষ কর্কট রোগে মারা যায়। চিকিৎসা আর সাহায্যের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে। এইসব মানুষজনের পাশে দাঁড়াক উদয়। তবেই সত্যি হবে, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই.....’
আমার অতি পরিচিত এক যুবকের নাম উজ্জ্বল। নিজাম উদ্দীন উজ্জ্বল। ঠিকভাবে গোঁফ গজানোর আগে থেকে পরিচয়। আমরা তখনো বৃদ্ধ হয়ে যাইনি। আমাদের সংগঠনের নাম ছিল সুধানির্ঝর। এই সুধানির্ঝর সিডনিতে অনেকগুলো চমৎকার অনুষ্ঠান করেছিল একসময়। যার মূল ভিত্তি ছিল গান আর কবিতা। উজ্জ্বলও এসেছিল গান গাইতে। সেই সময়েই আমার মনে হতো এই ছেলে টিকবে। লাগাতার স্রোতে ভাসার পরিবর্তে তার ভেতর আছে শুদ্ধতার প্রতি টান। সময় যায়। আমরা বুড়িয়ে পড়ি, উজ্জ্বলরা পোক্ত হয়। তাদের কণ্ঠ তাদের শক্তি তাদের সাধনা আরও বিকশিত হয়।
শনিবারের সন্ধ্যায় উজ্জ্বলের এককসংগীত সন্ধ্যাটি আমার বহুকাল মনে থাকবে। কী গায়নি সে? ক্লাসিক গজল আধুনিক নজরুল থেকে রবীন্দ্রনাথ সবকিছু গেয়েছে। বৈঠকি মেজাজের গজলগুলো যেমন স্বাভাবিক তেমনি তার গায়কিতে অন্য গানগুলোও ছিল অসাধারণ। মান্না দে’র গান গাওয়া সহজ কিছু না। চব্বিশ বছর আগে সিডনিতে মান্না দে’র বাংলা গানের আসরটি উপস্থাপন করার বিরল সুযোগ মিলেছিল আমার। কিংবদন্তি মান্না দে তখন আশি বছরের খোকা। সে সুর মূর্চ্ছনা এখনো কানে লেগে আছে। সত্যি বলতে কি এই সন্ধ্যায় তার কাছাকাছি মানের গান গেয়েছে উজ্জ্বল।
পরিবেশনার সাবলীলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হাঁকডাক ভাষণ পরিচয় এসবের কোনো বাহুল্য ছিল না। হারমোনিয়ামটি পাশে নিয়ে বসে দারুণ সব গান উপহার দিতে থাকল একের পর এক। মুগ্ধ হয়েছি নীলাদ্রি, সোহেল খান, সুবীর ও মিহিরের বাদ্যযন্ত্র বাজানোর মুনশিয়ানায়। তবলায় সুবীর মাত করে দিয়েছে পরিবেশ। নীলাদ্রি আমাদের অহংকার। সোহেল খান তো রক্তেই ধারণ করে সংগীত। তার মা দিলরুবা খানকে চেনে না এমন বাঙালি কী আছেন আসলে? মিহিরও কম যায় না।
এদের কথা বললাম এই কারণে আমরা মনে করতাম একটা যুগের অবসান হলে সিডনিতে আর বাংলা গান বাজনা হবে না। হলেও তা হবে দেশ থেকে কিংবা পশ্চিম বাংলা থেকে শিল্পী নিয়ে এসে। না তার দরকার আর নেই। সত্যি নেই। শুধু গান নয় নাটক সিনেমা কবিতা সব শিল্পেই সিডনিতে তারুণ্য টগবগ করে ফুটছে। উজ্জ্বলের বিশেষ যে দিকটি আমাকে আলোড়িত করেছে, তার গান নির্বাচন। অখিল বন্ধু ঘোষের মতো গায়কের গান নির্বাচন করে উজ্জ্বল বুঝিয়ে দিয়েছে তার শেকড় কত গভীরে। বাংলাদেশের গানের বেলায় ও তার কণ্ঠ জেবুন্নেসা জামাল আর নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীকে মনে করিয়ে দিয়েছে সে জানে, সে রাস্তা চিনে এগুচ্ছে।
শিখা গোমেজ, উজ্জ্বলের সুযোগ্যাপত্নী। যার সহযোগিতা ছাড়া প্রবাসে এমন অনুষ্ঠান করা দুঃসাধ্য তাকে ভালোবাসা জানাই। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল অনুষ্ঠানটির মান ও উপভোগযোগ্যতা। যা আমাকে বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে আমাদের তারুণ্য পারে। তারা অনেকদূর যাবে। একটাই কথা আছে বাকি, অতগুলো হিন্দি উর্দু গান না হলে ও চলতো না কি? বাংলা গান আর ক্লাসিক গানের অনুপম এই সন্ধ্যাটি সিডনি মনে রাখবে।

×