বিশ^জুড়ে চলছে পরিবেশ সুরক্ষার লাগাতার আন্দোলন আর কর্মসূচি। শস্য শ্যামল সবুজ প্রকৃতি ছায়াঘেরা নির্মলতার রূপশৌর্যে আবর্তিত সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই। গাছ-গাছালির নিরবচ্ছিন্ন শ্যামল স্নিগ্ধ অনন্য প্রতিবেশে জীবন ছিল এক শঙ্কামুক্ত, নিরাপদ বলয়। যা আজ শুধু কল্পনার আকাশে ছিন্ন-ভিন্ন এক মোহাচ্ছন্ন অনুভূতি। তেমন সুরম্য লীলা নিকেতনের মুক্ত প্রতিবেশে শ^াস নেওয়া আদিম সমাজ থেকে শুরু হওয়া এক শুদ্ধতার নির্মল রূপ। তেমন কালের এক পরিচ্ছন্ন যাত্রাপথ। কিন্তু সেই শ্যামল আর শান্ত স্নিগ্ধ বিশ^ আজ দাবানলের চরম প্রকোপে বিধ্বস্ত। ষড়ঋতুর নিয়মমাফিক বৈচিত্র্যও তার গৌরব হারানোর নেতিবাচক দুরবস্থায়। হেমন্তের স্নিগ্ধ আমেজে ভরা কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসেও রৌদ্র ঝলমল এক তপ্ত হাওয়ার অন্য মাত্রার পরিবেশ। শুরুতেই উল্লেখ করি এমন বিরূপ আবহ সৃষ্টির আদিতে বন্য মানুষদের সেভাবে আক্রান্ত করেনি। বন্যদশায় আদিম মানুষের লড়াই ছিল বেঁচে থাকার সংগ্রামী অভিযাত্রার অসহনীয় পরিস্থিতি। যা সামলাতে আদিম মানুষকে কাল-কালান্তরে দুঃসাহসিক সংগ্রাম করতে হয়েছে। বন্য হিংস্র পশুদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সম্মুখ সমর ইতিহাসের এক বিবর্ণ কালাতিক্রম। আদিম থেকে নব্য প্রস্তরের যুগ ইতিহাস যাত্রায় নতুন এক পরিক্রমা তো বটেই। তারপর এলো আলোকোদয়ের নবপ্রভাতের রবির কিরণ। পাথরে পাথরে ঘর্ষণ ঐতিহাসিক বিবর্তনের নতুন ধারায় এগিয়ে যাওয়া। আগুনের নবকিরণ নতুন সমাজের সূচনা পর্ব। প্রাচীন নৃতত্ত্ববিদরা বলছেন আগুনের আবিষ্কারই নাকি সভ্যতার উজ্জ্বলতম মাইলফলক। বন-বনান্তরে ঘুরে বেড়ানো আদিম মানুষ পশুপাখির কাঁচা মাংস খেতো বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। আগুনের আবিষ্কারে মানুষ কাঁচা মাংস ঝলসে খাওয়া শুরু করল। তারপর বিশ^ সৃষ্টির ইতিহাস এক অনধিগম্য যাত্রাপথের অংশীদার হয়ে নতুন সমাজ সভ্যতার বীজ বপন পৃথিবীকে সামনের পালাক্রমে ধাবিত করে। তাও সৃষ্টির সেরা মানব জাতির এক অভাবনীয় কর্মযোগ। কালক্রমে সমাজ নামক বৃহত্তর এক সংগঠনের অভ্যুদয় ইতিহাসের নর্বযুগ তো বটেই। কিন্তু বিজ্ঞান তখন অবধি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সঙ্গত কারণে নিত্যনতুন আবিষ্কারও সমাজ সভ্যতার ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে বারবার পিছু হটেছে। এভাবে কেটে গেল সপ্তদশ শতাব্দীর ক্রান্তিকাল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুভলগ্ন থেকেই বিশ^ এগিয়ে গেল নানামাত্রিক দেশ বিজয় আর বিভিন্ন জায়গায় তাদের উপনিবেশন স্থাপনে। আমাদের শ্যামল বাংলাও ছিল ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা এবং শস্য শ্যামল প্রান্তরের উর্বর পলিমাটির দেশ। নদীবিধৌত আর সমুদ্র পরিবেষ্টিত দেশটি ছিল বীজ বপন মাত্রই শস্য ফলার এক অপরিহার্য পলিমাটির উর্বর লীলা ক্ষেত্র। শুধু বাংলা নয় অবিভক্ত ভারত ছিল বৃহত্তর এশিয়ার এক অনন্য অচলায়তন চারণভূমি। শত রাজবংশের ভাঙা-গড়ার মাঝেও পরিবর্তন কিংবা গতিশীলতার দৃশ্য অধরাই ছিল বলে তৎকালীন পণ্ডিত মহলের বদ্ধমূল ধারণা। ইংরেজরাই প্রথম জাতি যারা ভারত উপমহাদেশের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য আর সভ্যতার ভিত নড়িয়ে দেয়। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের হাতে নবাব সিরাজদৌলার পতন বাংলার স্বচ্ছ নির্মল আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। পরিণতিতে ১৭৬০ সালে ইংল্যান্ডে ঘটে গেল যুগান্তকারী শিল্পবিপ্লব। আর এমন নতুন বিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট অর্থের জোগান দেওয়া। যা দিয়েছিল বাংলার রাজকোষ। খোদ ইংরেজ ইতিহাসবিদরাই নাকি বলেছেন ১৭৫৭ সালে ক্লাইভের হাতে বাংলার পতন না হলে ১৭৬০ সালের ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব হতো কিনা তা যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ ছিল। ইংরেজ লেখক ও সমাজবিদ অ্যাডাম স্মিথ নির্দ্বিধায় এমন সত্যালাপ করে গেছেন। মূল আলোচ্য বিষয় সহজাত প্রাকৃতিক শুদ্ধতা থেকে কেন আমরা ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হচ্ছি। সেটাও অজানা কোনো বিষয় কিংবা বিস্ময় নয়। কারণ আমরা জানি শিল্পবিপ্লব পরবর্তী বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ দেখেছি তা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়, যা বাংলার ১২৭৬ সালের দুর্যোগ।
অসহায় মানুষের প্রাণহানি থেকে অর্থ কষ্টের মতো নিদারুণ যন্ত্রণায় অবিভক্ত ঐশ^র্যশালী বাংলার যে মহা দুরবস্থা সেটা চিহ্নিত হয়ে আছে বহু ইতিহাসবিদের ক্ষুরধার তথ্য-উপাত্তে। সেই মহান শিল্পবিপ্লব যা সারা বিশ^কে যন্ত্র সভ্যতার অনুষঙ্গ করে নতুন আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী উপহার দেয়। তারই বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ দূষণের মতো আর এক বিপর্যয় বিশ^বাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। আধুনিক যন্ত্রশিল্প থেকে যে কার্বন নিঃসরণ সেটাই দূষণময় বিশ^কে নগ্নভাবে আলিঙ্গন করার যে বিষক্রিয়া তা অনুধাবন করতেও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের এক শতক পার করে দিতে হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে নিসর্গ বিজ্ঞানীরা জোরেশোরে আওয়াজ তুললেন ক্ষতিকারক আবিষ্কারের লাগাম টেনে ধরতে হবে। তা না হলে কোনো একসময় বাসযোগ্য ধরণিকে সম্মুখ সমর আরও কঠিনভাবে সামলাতে হবে। আমরা এখন সেই চরম অগ্নিস্নানের বিরূপ আবহকে সামলাচ্ছি। এমন দুঃসহ পালাক্রমে পরিবেশ বিশুদ্ধতায় কপ সম্মেলন সারা দুনিয়ায় সাড়া জাগিয়ে নৈসর্গ বিজ্ঞানীদের সচেতন দায়বদ্ধতায় হাজির করা হয়। শিল্প থেকে যে কার্বন নিঃসরণ হয় তাই নাকি বিশ^কে দাহ্য বস্তুতে পরিণত করতে সদা সক্রিয়। প্রকৃতি সহায়ক বিজ্ঞান যদি আবিষ্কৃত না হয় তাহলে সামনে কি হবে তা অনুমান করাও কঠিন। এখন আমরা তেমন দুঃসময়ের দুরন্তপণায় ক্রমান্বয়ে পতিত হচ্ছি।
সম্প্রতি আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত কপের ২৯তম আয়োজনে বক্তরা আরও সচেতন দায়বদ্ধতায় সবুজ পৃথিবী প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানান। পরিবেশকে তার যথার্থতায় রাখতে হলে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া পরিস্থিতির ন্যায্যতা। শুধু তাই নয় নতুন নতুন আবিষ্কার ও নবায়নযোগ্য প্রকৃতি সহায়ক যন্ত্র উদ্ভাবন সারা বিশ^কে নির্মল আবহের অনুগামী করবে। এর ব্যত্যয়ে বিশ^ আরও জ্বালাময় অবস্থাকে মোকাবিলা করে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে ঠেকবে। তবে আমাদের বাংলাদেশ উন্নত প্রযুক্তি খুব বেশি ব্যবহার করে না। কিন্তু বিষময় অবস্থাকে অনেক বেশি মোকাবিলা করতে হয় বলে তথ্য-উপাত্তে উঠে আসছে। শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এমন বিপরীত আবহ। কপ সম্মেলনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় অপেক্ষাকৃত ধনী দেশগুলো কর্তৃক জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোকে সাহায্য সহযোগিতা দেওয়া বাঞ্ছনীয়। তেমন অঙ্গীকার বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২৯ কপ সম্মেলনে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। আর এমন ক্ষতিপূরণের অঙ্কও বিরাট। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার লাগবে নাকি শুধু দক্ষিণ এশিয়াকে সহযোগিতা করতে গেলে। বরাবরের মতো এবারও অর্থ সংযোগের বিষয়টি অমীমাংসিত থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই মুহূর্তে সারা বিশ^ অতিক্রান্ত করছে পরিবেশ স্খলনের চরম বিষাদ ঘন পরিবেশ। তবে কপ-২৯ সম্মেলন কতখানি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে তা অতি অবশ্যই সময়ের হাতে। প্রথমবারের মতো প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজারবাইজানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ড. ইউনূস বললেন, পুরো মানব সভ্যতাই জলবায়ু হুমকির মুখে পড়েছে। সেখানে আনুষঙ্গিক বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করেন তারুণ্য শক্তিকে সামনে নিয়ে এসে অগ্রাধিকার দিতে। বিষময়, বিষণ্ন্ন পরিবেশকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’ বাস্তবায়নের ওপর এই ব্যাপক আয়োজনে তার পরামর্শ দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত হয়। মানব সভ্যতাকে ধ্বংসকারী মূল্যবোধ থেকে সৃজনশীল আদর্শে গভীর মনোযোগী হতে হবে। বুদ্ধিভিত্তিক, আর্থিক ও উদীয়মান তারুণ্যের শক্তিকে যথার্থভাবে কাজে লাগিয়ে আধুনিক ও পরিচ্ছন্ন প্রতিবেশের সূচক হিসেবে বিবেচনায় আনা ন্যায়সঙ্গত ও জরুরি। কপ-২৯ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে তার বক্তব্য তুলে ধরে সবক্ষেত্রে সমন্বয়ের বিষয়টি প্রাধান্য দেন। জলবায়ু দুর্যোগকে ভিন্ন প্রেক্ষিতে তুলে ধরে তার যথার্থ ও সময়োপযোগী সমাধানকে গ্রহণযোগ্য করতে অভিমত প্রকাশ করেন। ধ্বংসের উন্মত্ততাকে প্রত্যাখ্যান করতে জোরালো বক্তব্যে সকলের প্রতি আহ্বান জানান। সকলের মধ্যে বড় হওয়ার প্রবৃত্তি থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও পরিবেশ আর প্রকৃতিকে অতি অবশ্যই নয়-ছয় করে নয়। বিরূপ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে সংস্কৃতি, মূল্যবোধ আর জীবন ধারায় সহনীয় পরিবেশও একান্ত দরকার। আত্মরক্ষার্থক ও আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে আমাদের আগামীর বিশ^কে নতুন কর্মযোগ আর স্থিতিশীল পরিবেশ নিতান্ত জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক
পরিবেশ সচেতনতায় কপ-২৯ সম্মেলন
শীর্ষ সংবাদ: