ইন্টারনেট সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা বেশ তিক্ত। বিশেষ করে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের ইন্টারনেটের গতি বেশ ধীর। আর দুর্গম, পাহাড়ি এবং বিচ্ছিন্ন এলাকায় ইন্টারনেটের দুর্দশার কথা বলে শেষ করা যাবে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট সেবা চালু করেন স্পেসএক্সের মালিক ইলন মাস্ক। প্রথম ২০০৪ সালের জুনে শুরু করলেও ২০০৮ এসে ইএডিএস অ্যাস্ট্রিয়াম নামক অন্য একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন তিনি। তারপর ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ফের আত্মপ্রকাশ করে এবং ২০১৯ সাল থেকে পুরোদমে স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ শুরু করে। প্রাথমিক পরিকল্পনায় প্রায় ১২ হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ছয় হাজারের বেশি স্যাটেলাইট আকাশে পাঠিয়েছে সংস্থাটি, যেগুলো পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ঘুরে ঘুরে ৮০টির বেশি দেশে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। স্টারলিঙ্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীর সকল জায়গায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা। প্রথাগত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট একটি একক জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভর করে, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫ হাজার কিলোমিটার ওপরে প্রদক্ষিণ করে। দূরত্ব বেশি হওয়ার কারণে সংযোগ পেতে সময় বেশি লাগে, গতিও হয় কম। কিন্তু স্টারলিঙ্ক পদ্ধতি উপগ্রহগুলোর মধ্যে এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে যা পৃথিবী পৃষ্ঠের খুব কাছের (প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার) উচ্চতায় ঘোরে। ফলে, সংযোগ সময় কম লাগে এবং গতি পাওয়া যায় বেশি। পৃথিবীর বাইরে ছোট ছোট অনেক স্যাটেলাইট পাঠিয়ে সেগুলোর (জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের) মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার একটি বিকল্প পদ্ধতি হলো স্টারলিঙ্ক। এসব কারণে স্টারলিঙ্ক ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ ব্যবহারকারীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বিশেষ করে দূরবর্তী এলাকায় বসবাসকারীদের জন্য একটি বিকল্প ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে, যাদের কাছে অন্য কোনো উচ্চগতির ইন্টারনেট নেই।
স্টারলিঙ্ক অনেকটা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতো, ইন্টারনেট কানেকশন নিতে হলে টিভির ডিশ অ্যানটেনার মতো একটি অ্যানটেনা লাগাতে হয়। এই অ্যানটেনা স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং গ্রাহকের ঘরে রাখা স্টারলিঙ্কের ওয়াইফাই রাউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ ঘটায়। প্রথাগতভাবে পৃথিবীর বাইরে অনেক জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট স্থাপন করা থাকে। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার দূরের পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থিত এই স্যাটেলাইটগুলোকে জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট বলে। স্টারলিঙ্ক মূলত এই স্যাটেলাইটগুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করে। পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে অন্য কোনো কম্পিউটারের সঙ্গে ইন্টারনেট যোগাযোগ করতে হলে প্রথমে স্টারলিঙ্ক গ্রাহকের কম্পিউটার থেকে রিকোয়েস্ট কাছাকাছি স্যাটেলাইটে যায়। এরপর সেই রিকোয়েস্ট সেলুলার নেটওয়ার্কের মতো একটা থেকে আরেকটা স্যাটেলাইট হয়ে নির্দিষ্ট সার্ভারে পৌঁছায়। এরপর কাক্সিক্ষত তথ্য নিয়ে একই পদ্ধতিতে গ্রাহকের কম্পিউটারে (মোবাইল বা আইওটি) ফিরে আসে। স্টারলিঙ্ক এভাবে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে ছোট উপগ্রহের একটি অ্যারের (সারি) মাধ্যমে সীমাহীন উচ্চগতির ডেটা সরবরাহ করতে পারে। এর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ মেগাবিট (১৫০ এমবিপিএস)। স্পেসএক্স এই হার দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। উকলা স্পিডটেস্ট অনুসারে, স্টারলিঙ্ক লিথুয়ানিয়ায় ২০২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ১৬০ এমবিপিএস ডাউনলোড গতি রেকর্ড করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯১ এমবিপিএস, কানাডায় ৯৭ এমবিপিএস ও অস্ট্রেলিয়ায় ১২৪ এমবিপিএস পাওয়া গেছে। মেক্সিকোতে স্টারলিঙ্কের গতি রেকর্ড করা হয়েছে গড়ে ১০৫ দশমিক ৯১ এমবিপিএস।
পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের শুরু ১৯৮০-এর মাঝামাঝি সময়ে। বর্তমানে স্টারলিঙ্কের বিকল্প হিসেবে ধীরে ধীরে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক তৈরি করছে চীনের ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গিস্পেস। এখন পর্যন্ত ৩০টি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে সংস্থাটি। এই স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক সার্বক্ষণিক বিশ্বে ৯০ শতাংশ এলাকায় ইন্টারনেট সেবা দিতে পারে। গিস্পেসের স্যাটেলাইট পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ৩০০ থেকে ২ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় কাজ করেছে। সস্তা হওয়ার কারণে এসব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দ্রুত ইন্টারনেট সেবা দেওয়া যায়। সংস্থাটি ২০২২ সালে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে। গিস্পেস সব মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার স্যাটেলাইটের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে। তাই গিস্পেসকে স্টারলিঙ্কের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গিস্পেস প্রথম পর্যায়ে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সারাবিশ্বে ইন্টারনেট সেবা দিতে ৭২টি উপগ্রহ কক্ষপথে পাঠাবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে মুঠোফোন যোগাযোগের জন্য ২৬৪টি এবং তৃতীয় ধাপে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ডের জন্য পাঠানো হবে ৫ হাজার ৬৭৬টি স্যাটেলাইট। গিস্পেসের পাশাপাশি আরও কয়েকটি চীনা প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর জন্য কাজ করছে। সাংহাই স্পেসকম স্যাটেলাইট টেকনোলজি ‘জি৬০ স্টারলিঙ্ক’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সম্প্রতি ১০৮টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ ৬৪৮টি উপগ্রহ ও ২০৩০ সালের আগে ১৫ হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনেরও পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির। যাই হোক, স্টারলিঙ্ক মহাকাশ প্রতিযোগিতায় একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়। আছে ওয়ানওয়েব, হিউজনেট, ভিয়াস্যাট এবং অ্যামাজনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও। হিউজনেট ১৯৯৬ সাল থেকে পৃথিবীর ২২০০০ মাইল ওপরে থেকে সংকেত কভারেজ প্রদান করছে।
বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে স্টারলিঙ্ক গত কয়েক বছর যাবৎ। স্টারলিঙ্কের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট আসতে পারে। ব্যবহারকারীরা স্টারলিঙ্কে সাবস্ক্রাইব করলে তারা একটি স্টারলিঙ্ক কিট পাবে, যাতে একটি স্যাটেলাইট ডিশ, একটি ডিশ মাউন্ট এবং একটি ওয়াইফাই রাউটার বেস ইউনিট থাকে। অ্যান্ড্রয়েড এবং অ্যাপল আইওএসের জন্য একটি স্টারলিঙ্ক অ্যাপও রয়েছে যা ব্যবহারকারীদের তাদের রিসিভারদের জন্য সেরা অবস্থান এবং অবস্থান নির্বাচন করতে সহায়তা করে। স্টারলিঙ্ক যেহেতু স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা দেয়, তাই এর সিগন্যাল রিসিভ করতে অ্যান্টেনার প্রয়োজন হবে। অনেকটা ডিশের ছাতার মতো। তবে আকারে ছোট। এক ফুট ছাতা দিয়ে স্টারলিঙ্কের ইন্টারনেট সিগন্যাল যেকোনো প্রান্তে বসেই পাওয়া যাবে। এটি হলো একটি নিম্ন-আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট পরিষেবা (লেটেন্সি রেট এক পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে ডেটা স্থানান্তর করতে যে সময় লাগে)। কম বিলম্বের কারণে এগুলোর অনলাইন বাফারিং, গেমিং এবং ভিডিও কলিংয়ের মান ভালো হয়ে থাকে। স্টারলিঙ্কের উচ্চগতির ইন্টারনেট এই সেবা পেতে হলে গ্রাহককে ভালোই খরচ করতে হবে। প্রয়োজনীয় হার্ডওয়ার বাবদ গ্রাহক পর্যায়ে খরচ করতে হবে ৫৯৯ ডলার বা ৬৫ হাজার ৯৫৯ টাকা। প্রতিমাসে ফি দিতে হবে ১২০ ডলার বা ১৩ হাজার ২১৩ টাকা, যা প্রচলিত ইন্টারনেট সেবা থেকে অনেক বেশি। দেশে ৫ এমবিপিএস গতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের জন্য গ্রাহককে মাত্র ৫০০ টাকা এবং মোবাইলে ৩০ গিগাবাইট ইন্টারনেট কিনতে খরচ করতে হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অনেক উচ্চ গতির ইন্টারনেট। তারবিহীন তাই কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ইন্টারনেটে বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা নেই। সাবমেরিন ক্যাবল ও ইন্টারনেট তার ছিঁড়ে সেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও স্টারলিঙ্কে সেই আশঙ্কা নেই। এছাড়া যেকোনো জায়গা থেকে এর ব্যবহার করা যায়। কখনো কখনো এর গতি সাধারণত প্রতিশ্রুতির তুলনায় দ্রুত হয়ে থাকে। অসুবিধা হলো, এর ফলে উপগ্রহগুলো আকাশে আলো দূষণ তৈরি করতে পারে, উপগ্রহগুলো টেলিকম সরঞ্জামের সঙ্গে হস্তক্ষেপ করতে পারে, উপগ্রহগুলো মহাকাশের মধ্যে ময়লা তৈরি করতে পারে, স্টারলিঙ্ক একটি নতুন প্রযুক্তি এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখনো অজানা। লেটেন্সি সমস্যা স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় অসুবিধা এবং খরচ সাধারণ ইন্টারনেটের তুলনায় অনেক বেশি। প্রবল বৃষ্টি বা প্রবল বাতাসের কানেকশনকে বিঘ্নিত করতে পারে, যা ইন্টারনেটের গতিকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি ভিপিএনকে সমর্থন করে না। তবে এটি ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করছে এবং ভবিষ্যতে এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়