.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিধস বিজয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ভাবনার উদয় হয়েছে। রাজনীতির গতি প্রকৃতি বদলে যাওয়ার আভাস মিলছে। প্রসঙ্গত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী দেশ। গোটা বিশে^ই দেশটির রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান থেকেছে যুগ যুগ ধরে। বিশেষত: সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র একক মোড়ল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এই শক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সাড়া পৃথিবী গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। দেশটিতে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান এই দুটো দলের মধ্যে নির্বাচন যুদ্ধ সংগঠিত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল থেকে। এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা বা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কথা ছিল। কিন্তু সে রকম কিছু হয়নি।
কমলা হ্যারিস তেমন কোনো শক্ত প্রতিযোগিতা গড়ে তুলতে পারেননি। নির্বাচনি প্রচারকালে গণমাধ্যমগুলো আগাম জরিপে যে ফল প্রকাশ করেছে চূড়ান্ত ফলে তার সত্যতা মিলেনি। মোটকথা হিসেবটা ঠিক হয়নি। এখানে একটা রহস্য কাজ করেছে মনে করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। সেটি হচ্ছে ক্ষমতাসীন বাইডেন প্রশাসন মিডিয়াকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে উৎসাহিত করেছে। বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরেনি গণমাধ্যম। সে জন্যে সারাবিশ্বের মানুষ মনে করেছিল যে প্রার্থীই জয়লাভ করুক ব্যবধান হবে সামান্য। ট্রাম্পের বিশাল ব্যবধানের জয়টা বিস্ময়কর মনে হয়েছে বিশ্ববাসীর কাছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক মার্টিন ব্রায়ান্ত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ৯০ এর দশকে তিনি ওখঙ বাংলাদেশে কর্মরত থাকা অবস্থায় আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনি ধানমন্ডিতে থাকতেন। নিউইয়র্কে স্থায়ী নিবাস। মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা হয়। ঢাকায় নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। ঢাকায় এলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। ভালো বাংলাও বলতে পারেন। নির্বাচন প্রচারকালীন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম হোয়াইট হাউসের কর্তৃত্ব কার হাতে যাচ্ছে। তিনি সরাসরি বলেছিলেন ট্রাম্পই জিতবেন। আমি বলেছিলাম ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন নাগরিকের আস্থা রাখার কারণ কি? ট্রাম্প গত নির্বাচনে বাইডেনের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন। এই চার বছরে এমন কী কৃতিত্ব অর্জন করেছেন ট্রাম্প? তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একবার পরাজিত প্রার্থী দ্বিতীয়বার জয়লাভ করার নজির নেই বললেই চলে।
যা হোক, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি শপথ নেবেন। বাইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। বাইডেন অন্তর্বর্তী এই সময়টা শুধু রুটিন ওয়ার্ক করবেন। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ইতোমধ্যে প্রশাসনে ব্যাপক রদ-বদলের আওয়াজ উঠেছে। ট্রাম্প তার মন্ত্রিপরিষদ এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে যাদের বসাবেন তাদের একটা তালিকা তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন। একটা কথা প্রচলিত আছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে নেতার বদল হলেও নীতির বদল হয় না। বিশেষত: পররাষ্ট্রনীতি তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না। ভারতও এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যার পররাষ্ট্রনীতি সরকার বদলালেও অভিন্ন থাকে। তবে দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন অবশ্যই ঘটে। প্রত্যেক নেতারই একটা মনস্তাত্ত্বিক দর্শন থাকে। সে হিসেবে বাইডেনের মনস্তাত্ত্বি¡ক দর্শন আর ট্রাম্পের মনস্তাত্ত্বিক দর্শন এক হওয়ার কথা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নিয়েই এখন বেশি আলোচিত হচ্ছে। সাধারণত: দেশটির পররাষ্ট্রনীতি একটি কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। মৌলিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন না হলেও মনস্তাত্ত্বিক দর্শন পররাষ্ট্রনীতিতে কিছুটা প্রভাব পড়বে তা ধরে নেওয়া যায়। নির্বাচনি প্রচারকালে ট্রাম্প এজেন্ডা ৪৭ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ পেলে ট্রাম্প এবং রিপাবলিকানদের হাতে সম্পূর্ণরূপে নীতি নির্ধারণী ক্ষমতা চলে যাবে। এই ক্ষমতা পেলে সরকার ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দেওয়ার আভাস দিয়েছেন। ইতোমধ্যে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে চিফ অব স্টাফ হিসেবে সুসি ওয়াইলসকে নিয়োগ দিয়েছেন। দেশটির ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়োগ পেলেন। ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে মন্ত্রিসভা ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাদেরকে নিয়োগ দিবেন তা চূড়ান্ত করেছেন। যেমন- মার্কো রোবিউকে পররাষ্ট্রবিষয়ক দায়িত্ব দিয়েছেন। অন্যান্য যাদের দায়িত্ব দেবেন তারা হচ্ছে রাবর্ট এফ কেনেডি স্বাস্থ্য, মার্কিন ধনকুবের ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ইলন মাস্ক ও বিবেক রাম স্বামীকে সরকারি দক্ষতা বিষয়ক দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। পিট হেগসেথ প্রতিরক্ষা, মাইক ওয়ালৎস জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা, নর্থ ডাকোটার গভর্নর ডগবারগামকে স্বরাষ্ট্র, জন র্যাটাক্লফ সি.আই.এ এর পরিচালক, তুলসী গাবার্ডকে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। তুলসী গাবার্ড একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মহীয়সী নারী যিনি ইস্কনের আজীবন সদস্য। ম্যাট গোৎসকে অ্যাটর্নি জেনারেল, ক্রিস্টিনোয়েমকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটিবিষয়ক মন্ত্রী, টম হোম্যানকে অভিবাসন কর্মকর্তা, এলিস স্টেলানিককে জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। মাইক হাকাবিকে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত করেছেন অন্যদিকে ২৭ বছর বয়সী ক্যারোলিনকে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করে চমক সৃষ্টি করেছেন।
নতুন সরকার ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের পরিবর্তন আনবেন তার ছক তৈরি করেছেন এরমধ্যে রয়েছে অবৈধ অভিবাসী বিতরণ, কাগজপত্রহীন অবৈধ ১১ মিলিয়ন অভিবাসীকে দ্রুত বিতারণের কথা উল্লেখ রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন। এই প্রতিশ্রুতি কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবে এই বিষয়টি বিশ্ববাসীর ভাবনার খোরাকে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইন বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থাৎ গ্রীনকার্ড না পাওয়া অভিবাসীদের সন্তান জন্ম হলেও সেই সন্তান নাগরিকত্ব লাভ করতে পারবে না। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে সামাজিক কাঠামোতে একটা বড় ধাক্কা তৈরি হবে। শেষ পর্যন্ত এরকম সিদ্ধান্ত থেকে তিনি সরেও আসতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেক্সিকোর সীমান্ত রয়েছে। মেক্সিকো থেকে অবাধে আমেরিকা প্রবেশাধিকার বন্ধের পক্ষে ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ‘সিডিউল এফ, বাস্তবায়ন করবেন। অর্থাৎ বিগত বাইডেন প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করবেন। বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায় রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। ট্রাম্পের এই কার্যক্রমে সিভিলিয়ানদের সামাজিক অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রশাসনিক কার্যালয় ওয়াশিংটন থেকে অন্য কোনো প্রদেশে স্থানান্তরিত করবেন। তিনি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থার ওপর জোর দেবেন। আমদানি পণ্যে শুল্ক বৃদ্ধি করবেন। দেশীয় উৎপাদিত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে উৎসাহিত করতেই এই ব্যবস্থা। বিশেষত: চীনা পণ্যের ওপর ৬০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে অবশ্য বাণিজ্যিক যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি অবশ্য প্রথম থেকেই রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার নিয়ে ভাবছেন। দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও জোরদারে তার এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে মার্কিনীরা প্রত্যাশা করছে। সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করণে করপোরেশন ট্যাক্স কমানো ও বয়োজ্যেষ্ঠদের আরোপিত কর কাটছাট করবেন। স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় জোর দেবেন। তিনি বাইডেনের খাদ্য সহযোগিতার প্রোগ্রাম বাদ দিবেন কারণ এই প্রোগ্রামে খাদ্যের বণ্টন নিশ্চিত হয় না। এতে সরকারি ব্যয়ও বেড়ে যায়। খাদ্যের ব্যয় কমানোর জন্য উৎপাদনে জোর দেবেন এবং স্বাস্থ্য খাতে অপচয় রোধে নীতি প্রণয়ন করবেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের দিকে বিশ্ব তাকিয়ে আছে। যদিও ট্রাম্প আগ্রাসনবাদে বিশ্বাসী নয় তারপরও বিশে^র বিভিন্ন দেশে সৃষ্টকৃত অপরাধ দমনে কার্যকরী ভূমিকা রাখবেন। তিনি বিশে^র যে কোনো দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় দৃষ্টি নিবন্ধন করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করছেন। বিশেষত: বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দলবদ্ধ হামলার প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করেছেন। তিনি শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তুলতে গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার আহ্বানও জানিয়েছেন। ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ম এককভাবে মানুষের জীবন অনুশাসন করছে নিঃসন্দেহে। নিয়ন্ত্রিত জীবনে হয় শান্তির উপলব্ধি। কর্মবহুল জীবনে মানুষ চায় শান্তি কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে কখন? আন্দোলিত জলে সূর্যের প্রতিবিম্ব অস্পষ্ট। আসচ্ছ কাঁচে সূর্যের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয় না। মানুষ শান্তি ও শুদ্ধ স্বভাবের না হলে শান্তির প্রভাব উপলব্ধি হয় না। স্বার্থ বুদ্ধিপুষ্ট ও অব্যাবস্থচিত্ত মানুষের হাতের অস্ত্র নিরাপদ নয়। কিন্তু স্থিত প্রজ্ঞ মানুষ সেই একই অস্ত্র মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বে শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্ত্র যেন মানুষের কল্যাণে ঝলসে ওঠে এই প্রত্যাশা বিশ্ববাসীর। এটাই হোক ট্রাম্পের বিশ্বভাবনা।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক