ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

কমলা হ্যারিস

নারী প্রতিনিধি নাকি ডেমোক্র্যাট

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ২০:০৭, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

নারী প্রতিনিধি নাকি ডেমোক্র্যাট

কমলা হ্যারিসকে সাধারণভাবে প্রথম নারী ও প্রথম অশ্বেতাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা হলেও এই পরিচয়টি তার ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক প্রভাবকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করে না। তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং শক্তিশালী ক্যারিয়ার তাকে শুধু একজন নারী প্রার্থী নয়, বরং একজন প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কমলা হ্যারিস ক্যালিফোর্নিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন, যা তার প্রশাসনিক দক্ষতার প্রমাণ দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে তার অবস্থানকে আরও সুসংহত করে।
তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা তাকে বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটিক দলের ভরসাযোগ্য নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার এবং পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে তার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদক্ষেপ তাকে ডেমোক্র্যাটিক দলের আদর্শের সঙ্গে একত্রিত করেছে। পাশাপাশি বর্ণ এবং জাতিগত বৈচিত্র্যের প্রতীক হিসেবে হ্যারিস আমেরিকার বহু সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন, যা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর জন্য উৎসাহের প্রতীক। তবে কেবল এই পরিচয়ের কারণে তাকে মূল্যায়ন করাটা তার প্রকৃত যোগ্যতাকে আড়াল করবে। তাকে নারী প্রার্থী হওয়ার কারণে আমেরিকানরা নির্বাচিত করেনি এই সাধারণীকরণটা যুক্তিসংগত নয়। আমেরিকানদের নারীবিদ্বেষী ভাবার কোনো কারণ নেই। এর মাধ্যমে বরং নারীদের ছোট করা হয়; হ্যারিসকে মূল্যায়ন করতে হবে সার্বিক বিচারে। যেমন বাংলাদেশে দশকের পর দশক নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়া মানেই সমাজে নারী-পুরুষের সহাবস্থান ও সমমর্যাদা নির্দেশ করে না। তাদের চিন্তা-ভাবনা ও কাজে সমাজে প্রচলিত ভাবাদর্শের প্রতিচ্ছবি প্রতিভাত। এজন্য মার্কিন জনগণের নির্বাচনী আচরণ, বাস্তব চিত্র ও মনস্তত্ত্ব¡ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কেবল ‘নারী প্রার্থী’ হিসেবে বিবেচনা না করে একজন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে তার বিশ্লেষণ করতে হবে।
এটিও মনে রাখতে হবে যে, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ২০১৬ ও ২০২৪ সালে দুজন নারী প্রার্থী ট্রাম্পের নিকট পরাজিত হয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দুইবারের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের স্ত্রী; অন্যজন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট (আফ্রিকান-ইন্ডিয়ান আমেরিকান)। বিষয়টি হয়তো কাকতালীয়, তবে বিশ্লেষণের জন্য রয়েছে অনেক কিছু।
প্রথমবার ২০১৬ সালে ট্রাম্প ছিলেন ব্যবসায়ী (রাজনীতির অভিজ্ঞতাও কম ছিল)। এবার ২০২৪ সালে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট, অনেক অভিজ্ঞ ও ঝানু ব্যবসায়ী-রাজনীতিক। আমরা যদি একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করি দেখা যাবে ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন কিন্তু ট্রাম্প অপেক্ষা প্রায় ৩ মিলিয়ন ভোট বেশি পেয়েছিলেন (৪৮.২ শতাংশ-৪৬.২ শতাংশ), কিন্তু ইলেক্টোরাল ভোটার কারণে (৩০৬-২৩২) তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেননি। আর এবার ২০২৪ সালে কমলা হ্যারিস ৩ মিলিয়নের বেশি ভোটে পরাজিত হয়েছেন (৪৮ শতাংশ-৫০ শতাংশ; ২২৬-৩১২)। এর জন্য আরও অনেক বিষয় বিশ্লেষণের দাবি রাখে। যেমন ২০১৬ সালে ৪১ শতাংশ পুরুষ ও ৫৪ শতাংশ নারী হিলারিকে ভোট দিয়েছেন; কিন্তু ২০২৪ সালে ১ শতাংশ পুরুষ হ্যারিসকে বেশি ভোট দিলেও (৪২ শতাংশ)  ১ শতাংশ নারী কম (৫৩ শতাংশ) ভোট দিয়েছেন। এমনকি লাতিন ভোটাররা হিলারিকে ২০১৬ সালে ৬৭ শতাংশ ভোট দিলেও এ বছর হ্যারিসকে দিয়েছেন ৫২ শতাংশ। তাছাড়া পরিবর্তনের হাওয়ায় বাইডেন নীতিবিরুদ্ধ অবস্থান ও ট্রাম্প কারিশমায় কেবল জনপ্রিয় ভোট, ইলেক্টোরাল ভোট নয়, এমনকি সিনেটেও রিপাবলিকান শিবির সাফল্যের বিশেষ নজির সৃষ্টি করেছে।  
মার্কিন নির্বাচনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা চোখে পড়ে : সাধারণত এক রাজনৈতিক দল টানা দুই টার্ম (আট বছর) ক্ষমতায় থাকার পর ভোটাররা একটি ‘পরিবর্তন’ কামনা করে। এর ঐতিহাসিক উদাহরণগুলো এ ধারা প্রমাণ করে। উদাহরণস্বরূপ ২০০৯ সালে বারাক ওবামা ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যখন তার আগে আট বছর ধরে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ক্ষমতায় ছিলেন। একইভাবে ১৯৯৩ সালে বিল ক্লিনটন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যার আগে আট বছর ধরে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান ও জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশ শাসন করেছিলেন।
এই প্রবণতাটি প্রাসঙ্গিক। কেননা এটি মার্কিন নির্বাচনের রাজনীতিতে বিরোধী দলকে শক্তিশালী করার সুযোগ দেয়। যখন ক্ষমতাসীন দলের শাসন দীর্ঘকাল ধরে চলে তখন সাধারণত তাদের ওপর জনগণের অসন্তোষ বাড়তে থাকে। ক্ষমতায় থাকা দলকে নানা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার জন্য দায়ী মনে করা হয়, যা বিরোধী দলকে তাদের প্রচারে সুযোগ করে দেয়। ফলে প্রতিবারই ক্ষমতায় থাকার পর একটি দল পরবর্তী নির্বাচনে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, বিশেষ করে যখন তারা টানা দুই টার্ম শাসন শেষ করে। এই প্রবণতা থেকে দেখা যায়, মার্কিন রাজনীতিতে ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য জনগণের আকাক্সক্ষা বিরোধী দলকে নির্বাচনে বিজয়ের পথ সুগম করতে সহায়তা করে।
এই ধারাবাহিকতা ইঙ্গিত করে যে, নির্দিষ্ট সময় পর জনগণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও নেতৃত্বে পরিবর্তন দেখতে চায়। ‘পরিবর্তনের জন্য চাহিদা’ মূলত জনগণের মধ্যে নতুন প্রতিশ্রুতি, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন সমস্যা সমাধানের আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রেসিডেন্ট পুনরায় প্রার্থী না হলে বিরোধী দল সাধারণত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। কারণ তারা নিজেদের ভোটারদের সামনে ‘নতুন’ ও ‘উন্নতির প্রতীক’ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে।
২০২০ সালে ট্রাম্পকে পরাজিত করে বাইডেনের নির্বাচিত হওয়া এ প্রবণতারই উদাহরণ। ট্রাম্পের শাসনামলে করোনাভাইরাস মহামারি ও জলবায়ু সংকটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ তার জনপ্রিয়তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। তাই বাইডেন বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার গত চার বছরের নেতৃত্বে কিছু চ্যালেঞ্জ, বিশ্বময় যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা দেখা দেওয়ার কারণে আবারও ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে বীরদর্পে। এ বাস্তবতায় হ্যারিসের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ ভাবনা সুস্পষ্ট ও বাইডেন অপেক্ষা স্বতন্ত্র কি না সেটাই ভোটারদের কাছে মূল বিবেচ্য ছিল।
কমলা হ্যারিসের জাতপাত, লিঙ্গ, ধর্ম, অভিজ্ঞতা ইত্যাদিকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে এবারকার নির্বাচনে মন্দের বাস্তববাদী ‘ভালো’তে (ট্রাম্প) নির্ভর করেছেন আমেরিকান ভোটাররা। এশিয়া, আরব ও আফ্রিকার ডায়াস্পোরা সম্প্রদায়সহ আমেরিকার জনগণ ডেমোক্র্যাট ও বাইডেনের ওপর আস্থাহীন হয়ে পড়ে হ্যারিসের মধ্যে বাইডেনের ছায়া দেখলেও তার মাঝে কোনো স্বাতন্ত্র্য ও বিশ্বশান্তির সম্ভাবনা খুঁজে পায়নি তারা। বিকল্পস্বরূপ রিপাবলিকান ট্রাম্পকে বেছে নিয়েছে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার মূল্যায়নে, যুদ্ধ বন্ধ ও বিশ্বশান্তির প্রত্যাশায়।  
এসব বিবেচনায় কমলা হ্যারিসকে শুধু একজন নারী প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা তার আসল পরিচয় এবং অর্জনের প্রতি সুবিচার করা হয় না। বরং তার রাজনৈতিক অবস্থান মার্কিন রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাটিক দলের দীর্ঘ ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের প্রতিফলন, যা হ্যারিসের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দৃঢ়তাকে তুলে ধরে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং মার্কিন রাজনীতির অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এই নির্বাচনের গতি-প্রকৃতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রার্থীর লিঙ্গ প্রধান বিবেচনা নয়, বরং তার রাজনৈতিক যোগ্যতা, দলীয় অবস্থান এবং জনগণের আস্থা অর্জনের ক্ষমতাই প্রার্থীর বিজয় নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করে। তবে সার্বিক বিচারে গতবারের ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট অপেক্ষা স্বতন্ত্র অবস্থান সৃষ্টির ব্যর্থতা এবং তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও নিজস্ব  পরিচয়-ব্যক্তিত্বের কারণে হ্যারিস পরাজিত হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থীর বাস্তবাদী ব্যবসানীতি ও রাজনীতির কাছে।
মার্কিন নির্বাচনে বিভিন্ন ডায়াস্পোরা কমিউনিটির ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রভাব আরও বেড়েছে। এশিয়ান-আমেরিকান, আরব-আমেরিকান, আফ্রিকান-আমেরিকান এবং লাতিন আমেরিকান ভোটাররা ক্রমবর্ধমানহারে মার্কিন রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন এবং তাদের সমর্থন নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে। এই সম্প্রদায়গুলোর বৈচিত্র্যময় চাহিদা এবং মতাদর্শিক অবস্থান ভোটারদের আচরণে চমকপ্রদ পরিবর্তন এনেছে, যা কমলা হ্যারিসের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করার পাশাপাশি তাকে সমূহ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে।
ডায়াস্পোরা ভোটারদের সমর্থন পেতে হলে প্রার্থীকে কেবল লিঙ্গ নয়, বরং তার রাজনৈতিক অবস্থান, অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বসমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি তাদের স্বার্থ ও প্রয়োজনগুলোকে গুরুত্ব দেন। ভবিষ্যতের প্রার্থীরা যদি জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও পরিপক্ব হন তাহলে ডেমোক্র্যাটদের বিজয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে, যা কেবল রাজনৈতিক দলের সাফল্য নয়, বরং একটি বৈচিত্র্যময় আমেরিকার প্রতিফলন হিসেবেও গুরুত্ববহ হবে। রিপাবলিকানদের ক্ষেত্রেও সেটা সমভাবে প্রযোজ্য। তবে নারী প্রার্থীর ক্ষেত্রে লিঙ্গ অপেক্ষা প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অন্য গুণাবলীর দিকে সুবিচার করা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে তার অনন্য ব্যক্তিত্ব ও স্বতন্ত্র অবস্থান জরুরি। বিশ্ববাসীর কাছে নারী-পুরুষ ও সাদা-কালো নির্বিশেষে বিশ্বময় চলমান সংঘাত নিরসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের প্রধানতম শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান দেশের প্রেসিডেন্টের ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশিত।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×