ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

পরিযায়ী পাখি হত্যা নয়

মো. রাসেল হোসেন

প্রকাশিত: ১৮:৫২, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

পরিযায়ী পাখি হত্যা নয়

প্রকৃতিতে শীতের আমেজ শুরু হলে ভোরের শিশিরবিন্দু জমে থাকে পাখির ঠোঁটের ডগায়। দূরদিগন্ত থেকে উড়ে আসে অনেক পরিযায়ী পাখি। হেমন্তের পাকা ধানের সুবাস শেষ হলেই উত্তরের হিমেল বাতাসে ভর করে ওরা ভিড় জমায় আমাদের দেশে। সাধারণত অক্টোবরের শেষ নভেম্বরের শুরুতে এসব পাখি আমাদের দেশে আসতে শুরু করে। বিল-ঝিলগুলো তখন পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। এসব পাখির মধ্যে- বালিহাঁস, পাতিহাঁস, রাজসরালি, ডাহুক, পানকৌড়ি, নলকাক, গাংচিল, হুটটিটি, হারগিলা, শামুককনা, সারস, জললিপি উল্লেখযোগ্য। কাইম, ডাক, বালিহাঁস অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির পাখি। এদের ওজন প্রায় এক থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

বর্তমানে শীতের আগমনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখি বা অতিথি পাখি এবং বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের হাওর উপকলীয় এলাকা ছাড়াও সমতলের বেশ কিছু এলাকায় এখন থেকে নিয়মিত কয়েকমাস এসব পাখির দেখা মিলবে। এসব পরিযায়ী পাখি হাজার হাজার মাইল দূরের পথ উড়ে আমাদের দেশে আসে তীব্র শীত খাদ্যাভাব থেকে বাঁচার জন্য। আসে দূর সাইবেরিযা, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, হিমালয়ের পাদদেশ, চীনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। আসতে শুরু করে নভেম্বর মাসে এবং এপ্রিল পর্যন্ত থাকে। এই অল্পদিনেই এরা হয়ে যায় আমাদের বন্ধু। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ওই পাখিরা। এসব পাখির মধ্যে অধিকাংশই জলচর হাঁস-প্রজাতি। বৃক্ষচারী পাখিও আছে, তবে সংখ্যা কম। জীবজগতের মধ্যে পাখিরাই সর্বাধিক পরিযায়ী। শীতের এসব পাখিকে অতিথি পাখি বলেন অনেকে। পাখি অতিথি নয়, পাখি কোনো দেশের নয়। তবে পাখিদের দেশভিত্তিক একটা তালিকা থাকতে পারে।

মূলত বর্ষার শেষে এবং শীতের আগে থেকেই এসব পাখি বাংলাদেশে আসা শুরু করে এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় মার্চ মাসের শেষ নাগাদ থাকার পর আবার ফিরে যায় পাখিগুলো। বাংলাদেশে অবস্থানকালে মূলত টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বিভিন্ন হাওর এলাকা আর কক্সবাজারের সোনাদিয়ার মতো বেশ কিছু দ্বীপের উপকলে এসব পাখির ব্যাপক উপস্থিতি চোখে পড়বে। বরিশালের দুর্গাসাগর, নীলফামারীর নীল সাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, আর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়াও নিঝুম দ্বীপ, ঢালচর, চরকুকরী,চট্টগ্রাম বিভাগের চর বারী, বাটা চর,গাউসিয়ার চর, মৌলভীর চর, মুহুরী ড্যাম, মুক্তারিয়া চর, ঢাল চর, নিঝুম দ্বীপ, পতেঙ্গা সৈকত, সোনাদিয়া মহেশখালী দ্বীপ; সিলেট বিভাগের আইলার বিল, ছাতিধরা বিল, হাইল হাওর বাইক্কা, হাকালুকি হাওর, পানা বিল, রোয়া বিল, শনির বিলসহ দেশের বিভিন্ন চর বা বিলে এসব পাখির ঝাঁক দেখা যায় শীতের সময়ে।

পাখি হলো প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাখি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়ায় না, আমাদের অনেক উপকারও করে। ফসলে ভাগ বসিয়ে পাখিরা মানুষের যেটুকু ক্ষতি করে, উপকার করে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি।পাখি প্রকৃতি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, কিচিরমিচির কলকাকলিতে মানুষকে আনন্দে মোহিত করে। পাখিগুলো শুধু জলাশয়ের সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসল রক্ষা করে। পাখির মল জমির উর্বরতা বাড়িয়ে গাছপালা দ্রæ বর্ধনে সহায়তা করে। ফুল থেকে ফলে রূপান্তরে পাখির মিকা গুরুত্বপূর্ণ।

পরিযায়ী পাখিদের জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশেও এখন নিরাপদ নয়। মানুষের অজ্ঞতা অসচেতনতার ফলে দেশে পরিযায়ী পাখিরা আজ বিপন্ন।অনেকে পাখি শিকারকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। অনেকেই গুলি করে, বিষটোপ ব্যবহার করে, জাল পেতে পাখি শিকার করছে।শিকারিরা গুলি করে, বিষটোপ ব্যবহার করে, জাল পেতে অতিথি পাখি হত্যায় মেতে ওঠে। শীত মৌসুমে বাজারে সবার সামনে অতিথি পাখি বিক্রিও করতে দেখা যায়। অনেকে রসনা তৃপ্তিতে বাড়িতে পরিযায়ী পাখি কিনে আনে। পাখি শিকার করা মানে নিষ্ঠুরতা অমানবিকতার পরিচয় দেওয়া। যে পাখিরা শুধু জীবন খাদ্যের সন্ধানে আমাদের মতো দেশে আসে, নিজেদের অসচেতনতা লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু লোক সেই পাখিদের জীবন নষ্ট করছে বা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। মানবিক মানুষের এমন অমানবিক আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। অতিথি পাখি প্রকৃতি পরিবেশের বন্ধু। অতিথি পাখি শুধু জলাশয়ের অপরূপ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না, আমাদের উপকারও করে।অথচ বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী, পাখি হত্যার দায়ে একজন অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদÐ অথবা সর্বোচ্চ লাখ টাকা অর্থদÐ অথবা উভয় Ð Ðিতের বিধান রয়েছে। আবার কোনো ব্যক্তি পরিযায়ী পাখির ট্রফি বা অসম্পূর্ণ ট্রফি, মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করলে, ক্রয় বিক্রয় করলে বা পরিবহন করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং উক্ত অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ মাস পর্যন্ত কারাদÐ অথবা ত্রিশ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় Ð Ðিত হবেন এবং এই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদÐ অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার অর্থদÐ বা উভয় Ð Ðিত হবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে , এসব আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না। প্রশাসনের উচিত পাখি শিকার বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া এবং প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ।অতিথি পাখিরা নামেই শুধু অতিথি। এদেরকে নির্বিচারে হত্যা না করে অতিথির মর্যাদা দেওয়া উচিত।

অতিথি পাখির জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে প্রত্যেক দপ্তরের দু-একজন কর্মচারী-কর্মকর্তাকে পাখি পরিচর্যা লালন-পালনের পদ্ধতিগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।কেউ আইন অমান্য করে পাখি শিকার করলে তার জেল-জরিমানা হতে পারে। আইনটি সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। আইন অমান্য করলে যে শাস্তি পেতে হবে সেটা প্রচার করতে হবে। যতই আইন থাকুক না কেন জনসাধারণের সচেতনতা ছাড়া পাখি শিকার বন্ধ করা অসম্ভব। শুধু প্রশাসন পাখি শিকার বন্ধ করতে পারবে না। জনসাধারণের ঐকান্তিক চেষ্টাই পারে পাখি শিকার বন্ধ করতে। সবাইকে সচেতন হতে হবে, পাখি শিকারিদের  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে। অতিথি পাখি আমাদের দেশে আসুক। কলকাকলিতে ভরে উঠুক জলাশয়ের চারপাশ।

 

শিক্ষার্থী,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

×