‘নারী’- এই একটা শব্দেই যেন নিহিত থাকে গোটা পৃথিবীকে পরিপূর্ণ করে তোলার এক অনন্য শক্তি। পৃথিবীর প্রত্যেকটা কোনায় নারীরা তাদের সাধনা ও পরিশ্রম দিয়ে সমাজে এক অনন্য ভ‚মিকা রেখেছে। নারী যে শুধুমাত্র একজন মা, বোন, স্ত্রী বা মেয়ে বিষয়টা তা নয়, বরং নারী হলো একজন শিল্পী, লেখক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, নেত্রী এবং উদ্ভাবক। যুগে যুগে নারীরা তাদের দক্ষতা, মেধা, শ্রম এবং সাহস দিয়ে প্রমাণ করেছে যে তারা শুধুমাত্র পরিবারের আঙিনায় নয়, বরং কর্মক্ষেত্রেও তাদের অবদান অনেক বেশি। বর্তমানে নারীরা শুধু সহকারী ভ‚মিকা পালন করছে না বরং তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে, উদ্যোক্তা হয়ে উঠছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্ভাবনারও সূচনা করছে। কিন্তু বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা আজকের দিনে একটি প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও নারীরা আধুনিক সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে, তবুও কর্মক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা, সমান সুযোগ এবং সুরক্ষা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েই গেছে। এই যে এত অগ্রগতির পরও নারীরা কি তাদের কর্মস্থলে আদৌ নিরাপদ? কর্মক্ষেত্রে তারা তাদের সমান সুযোগ-সুবিধা বা তাদের সুরক্ষা কি পাচ্ছে? নারীরা কি কর্মস্থলে শুধুমাত্র তাদের মেধা ও দক্ষতার বলেই আসছে নাকি তাদের নারী হওয়াটাই এখন বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?
বর্তমানে কর্মস্থলে নারী নির্যাতন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই আছে যারা নারীকে অনেক আড় চোখে দেখে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে অবমূল্যায়ন বা অবজ্ঞাও করা হয়। যার ফলে একজন নারীকে তার কর্মস্থলে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখেও পড়তে হয়। এই কর্মস্থলে একজন নারী শারীরিক, মানসিক, যৌন অথবা আর্থিক ইত্যাদি আরও অনেকভাবে নির্যাতিত হয়ে থাকে। এমনকি কর্মস্থলে নারীদের যৌন হয়রানিরও স্বীকার হতে হয়। আবার দেখা যায় কর্মস্থলে অনেক ছেলেরা নারীদের শারীরিক গঠন নিয়ে অশালীন, আপত্তিকর বা যৌনতা সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ কথা বলে। এমনকি অনেকে নারীর প্রতি অশালীন দৃষ্টিও দেয় এবং অনেক অস্বস্তিকরভাবে শরীরী ভাষাও ব্যবহার করে। যার ফলে মানসিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কাজ করার মনোবলও হারিয়ে ফেলে। এছাড়া অনেক সময় কর্মস্থলে শারীরিক আঘাত কিংবা মারধরও সহ্য করতে হয়। শুধু যে নারীরা কর্মস্থলে শারীরিকভাবেই নির্যাতিত হয় বিষয়টা তা নয় বরং তারা মানসিকভাবেও নির্যাতনের শিকার হয়। অনেকেই আছে যারা নারীর কাজ বা সিদ্ধান্তের প্রতি অবজ্ঞা বা উপহাস করে। এমনকি কাজের ক্ষেত্রে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে, ভয় দেখায়, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এবং অনেক অপমানজনক মন্তব্যও করে। যার ফলে তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমনকি সমান সুযোগ-সুবিধা বা অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে হয়। কর্মস্থলে নারীরা যদি নিরাপদই না থাকে, তাহলে কি তাদের কাজের প্রতি মনোবল বাড়বে?
না, কখনোই বাড়বে না। নারীর নিরাপত্তা শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনকেই নয় বরং পুরো কর্মপরিবেশকে প্রভাবিত করে। যখন একটি নারী কর্মী শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হন, তখন তার কাজের প্রতি আগ্রহ ও মনোযোগ হ্রাস পায়। এটি শুধু তার কর্মদক্ষতা এবং মানসিক স্থিতিশীলতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না বরং প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা এবং কার্যক্রমেও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। কর্মস্থলে নারীদের নির্যাতন বিশেষ করে শারীরিক বা যৌন হয়রানি তাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যার কারণে নারীরা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং আস্থাহীনতায় ভোগে। এই ধরনের মানসিক চাপ এবং হতাশা তাদের আত্মবিশ্বাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং শারীরিক সমস্যাও তৈরি করতে পারে যেমন- অনিদ্রা, অস্থিরতা, মাথাব্যথা এবং আরো অনেক ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। এছাড়াও কর্মস্থলে নারী নির্যাতনের শিকার হলে তারা তাদের কাজের প্রতি আগ্রহ এবং মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। এমনকি নির্যাতন তাদের কর্মক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। ফলে তারা কাজের পরিবেশে অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাদের মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ তাদের কাজে ঘাটতি সৃষ্টি করে। যা পুরো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়াও নারী নির্যাতনের কারণে প্রতিষ্ঠানে অবিশ্বাস এবং অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় তখন কর্মীরা এই বিষয় নিয়ে আস্থাহীনতায় ভোগে। যার ফলে নারী কর্মীরা তাদের অধিকার বা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না এবং কর্মস্থলে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। আপনি এমনকি কর্মীরাও সহকর্মীদের প্রতি বিশ্বাস হারায় এবং সহযোগিতারও অভাব লক্ষ্য করা যায়।
২০০০ সালে আইনি কাঠামো এবং নীতিমালা অনুসারে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। যেখানে কর্মস্থলে যৌন হয়রানি দমনের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু এই আইন থাকলেও এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্র অনেক দুর্বল। এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে যথাযথভাবে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়নি। এমনকি এই আইন থাকা সত্বেও অনেক নারী এখনো চুপ আছে। তাছাড়া নারীরা অভিযোগ করলেও প্রমাণ বা যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অভাবে অনেক অভিযোগ নিরুৎসাহিত হয়ে যায়। এছাড়া ভুক্তভোগীরা বেশিরভাগ সময় সামাজিক বা পেশাগত কারণে প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। এই পরিস্থিতি শুধু নারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না বরং পুরো কর্মক্ষেত্রের স্বাস্থ্যকর পরিবেশও নষ্ট করে দেয়।
তাই কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বপ্রথম সিসিটিভি ক্যামেরা, নিরাপত্তা প্রহরী এবং অন্যান্য শারীরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এমনকি বিশেষভাবে নারীদের জন্য নিরাপদ গেটপাস, পার্কিং স্পেস এবং তাদের কাজের পরিবেশে যেনো কোনো ধরনের ঝুঁকি দেখা না যায় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মীদের জন্য বিশ্রামের স্থান, শৌচাগার এবং অন্যান্য মৌলিক সুবিধা উপযুক্ত ও নিরাপদভাবে আছে কি না সেদিকেও নজর দিতে হবে। নারীদের কাজের ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো সমান সুযোগ সুবিধা দিতে হবে এবং নারী কর্মীদের পদোন্নতি, বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য দূর করতে হবে। এছাড়াও কর্মস্থলে পুরুষ ও নারী কর্মীদের মধ্যে কোন ধরনের লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বা হেয় প্রতিপন্ন কোনো কথা যেনো না হয় সেদিকে কঠোর নজর দিতে হবে এবং নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নারী কর্মীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তারা যেনো কর্মস্থলে কোন ধরনের যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার না হয় এই ব্যাপারে তাদের সচেতন করতে হবে। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে নারীরা যদি নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে তারা যেনো কোন প্রকার ভয় ভীতি ছাড়া অভিযোগ করতে পারে তাই একটি গোপনীয় অভিযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের অভিযোগের পর যেনো তদন্ত প্রক্রিয়া স্বচ্ছ এবং মার্জিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নারীদের মনোবল বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মশালা, সেমিনার বা গ্রæপ প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত মনিটরিং, রিপোর্টিং এবং প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাই নারীর প্রতি সহানুভ‚তিশীল মনোভাব তৈরি করার জন্য সবাইকে একযোগ হয়ে প্রতিষ্ঠান, সমাজ এবং সরকারের ভ‚মিকা যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
তাই সমাজ সমৃদ্ধি করার জন্য কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তা অনেক দরকার। কিন্তু কর্মস্থলে নারীদের নিরাপত্তা শুধু যে নারীদের একার দায়িত্ব বিষয়টা তা নয় বরং এটি আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। যখন আমরা সবার জন্য একটি নিরাপদ, সমান এবং সঠিক কর্মপরিবেশ তৈরি করতে পারব ঠিক তখনই আমাদের সমাজ একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে গড়ে উঠবে। তাই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে আমরা শুধু নারীকে নয় বরং পুরো সমাজকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। তাই কর্মস্থলে নারীর সুরক্ষা হোক উন্নত সমাজ গঠনের একমাত্র পথ।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ