প্রতি বছর নভেম্বরের তৃতীয় রবিবার সড়ক দূর্ঘটনায় ভিকটিমদের জন্য বিশ্ব স্মরণ দিবস হিসেবে পালিত হয়। যেখানে স্মরণ করা হয় লাখো মানুষের সড়ক দূর্ঘটনার পরিণতির কথা। কেউ অল্প বয়সে আহত হয়ে বাকি জীবন হয়ে যাচ্ছে দুর্বিষহ, আবার কেউ স্বজনদের কাঁদিয়ে নিহত হয়ে চলে যাচ্ছে না ফেরার দেশে। ঠিক প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার পরিণতি এমনই হতাশার, হাহাকারের এবং জীবনাশের। পত্রিকার পাতা উল্টাতেই প্রতিনিয়ত সামনে আসে বেশ কিছু সড়ক দূর্ঘটনার সংবাদ। সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটি) এর তথ্য মতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৪-১৫ জনের মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়াও পত্র-পত্রিকা বা গণমাধ্যমের বাহিরেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে অথবা আমাদের সামনেই ঘটে চলছে এমন নানান মরণঘাতী দূর্ঘটনা। প্রতিটি আহত ব্যক্তি মাথায় আঘাত পাওয়া, হাত-পা ভেঙে যাওয়া, শরীরের বড় রকম ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া আবার কেউ কেউ নিহত হয়ে স্বজনদের ছেড়ে পরপারে চলে যাওয়া। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় স্বীকার এমন ব্যক্তির পরবর্তী জীবনের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো কীভাবে একটি ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের করুণ পরিণতি হয়েছে সামন্য একটা দুর্ঘটনার বদৌলতে। যার ফলস্বরূপ ব্যক্তি নিজের লক্ষ্য, ভারসাম্য হারিয়ে অন্য উপর নির্ভরশীল হচ্ছে যা তাকে পরিবার এবং রাষ্ট্রের বোঝা বানাচ্ছে। যারা নিহত হচ্ছে তাঁর পরিবারকে নিঃসঙ্গতায় পতিত করা এবং হয়তো পরিবারের বিপদ-আপদে তাঁকে খুব প্রয়োজন ছিল তা থেকে পরিবারের বঞ্চিত হওয়া। এছাড়াও একজন নাগরিক নিহত হওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার মানবসম্পদ হারাচ্ছে, যিনি বেঁচে থাকলে হয়তো দেশের অনেক বড় রক্ষক হতে পারতেন।
বাংলাদেশর সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ গুলোর দিকে যদি দৃষ্টিপাত করি তাহলে এর তিনটি দিক দিয়ে এটা ঘটে থাকে। প্রথমত চালকের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় যেমন: অদক্ষতা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ক্লান্ত জনিত ঘুম, আইন অমান্য করা ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত পথচারীদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় যেমন: বেখেয়ালি রাস্তা পারাপার হওয়া, রাস্তা পারাপারের সময় ট্রাফিক সিগন্যাল বা ট্রাফিক আইন সম্পর্কে না জানা বিশেষ করে ট্রাফিক সাইন লক্ষ্য না করা, ওভার ব্রিজ বা জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার না করা, বাচ্চাদের খেয়াল না রাখা ইত্যাদি। তৃতীয় যে বিষয়টি তাহলো রাস্তা জনিত সমস্যা যেমন: রাস্তা ভেঙে যাওয়া, এক লেনের হাইওয়ে, যথাস্থানে ট্রাফিক ম্যান না থাকা, রাতের জন্য উপযুক্ত আলো না থাকা, ট্রাফিক সাইন নিশ্চিত না করা বিশেষ করে জটিল এবং ক্রটিপূর্ন স্থানে সতর্ক সংকেত না দেওয়া ইত্যাদি।
আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক সড়ক দূর্ঘটনা এড়াতে ট্রাফিক সাইন কিভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে। ট্রাফিক সাইন হলো রাস্তার সাংকেতিক কিছু চিহ্ন যা রাস্তার শুরুতে, পাশে, রাস্তার সংযোগ স্থলের শুরুতে, বিপদজনক অঞ্চলের শুরুতে বোর্ডের মধ্যে বা খুটিতে অঙ্কিত কিছু নির্দেশনাকে ট্রাফিক সাইন বলে। সড়ক চিহ্ন মূলত তিন প্রকার ১.বাধ্যতামূলক সংকেত যার প্রকার আবার দুইটি হ্যা সূচক আর না সূচক। হ্যা সূচক এমন কিছু সাইন যা রাস্তা চলাচলে আমাকে মানতেই হবে। এই সাইন সমূহ সাধারনত গোলাকার বৃত্তের মধ্যে থাকে। বাধ্যতামূলক সাইন যেহেতু দুই প্রকার তাই বাধ্যতামূলক না বাচক সাইন সমূহ লাল বৃত্তের মধ্যে থাকে এবং হ্যাঁ বাচক সাইন সমূহ গোল বৃত্তের মধ্যে সম্পূরক চিহ্ন সমূহ থাকে। না সূচক যা আমাকে রাস্তা চলাচলে বর্জন করতে হবে৷ রাস্তায় না বাচক চিহ্ন থাকলে অবশ্যই সেটা করা যাবে না যেমন- ডানে / বামে মোড় নিষেধ, হর্ণ বাজানো নিষেধ, পাথচারী পারাপার নিষেধ, পাকিং ও ওভারটেকিং নিষেধ, সর্বোচ্চ গতিসীমা ও সর্বোচ্চ ওজনসীমা ইত্যাদি
২. সর্তকতামূলক সাইন আমাদের রাস্তায় চলাচলের বিভিন্ন প্রকার সর্তকতার নির্দেশনা দিয়ে থাকে। যেমন ডানদিক থেকে আগত রাস্তা প্রধান সড়কে মিলিত হয়েছে সে ক্ষেত্রে চালককে অবশ্যই তার গাড়ির গতি কমিয়ে ডান পার্শের রাস্তায় আগত যানবাহনকে আগে যেতে দিতে হবে। এছাড়াও টি জংশন, সামনে আকাবাঁকা রাস্তা, চৌরাস্তা, সামনে বাজার , স্কুল, গতিরোধক , জেব্রা ক্রসিং ও ট্রাফিক আলোর সংকেত ইত্যাদি আমাদেরকে সর্তকতা নির্দেশ করে থাকে।
৩. তথ্যমূলক সাইন আমাদেরকে রাস্তায় চলাচলের জন্য নির্দেশনা সরবরাহ করে থাকে। এর ফলে রাস্তায় চলাচলের জন্য চালক-যাত্রী-পথচারী সকলের সুবিধা হয়। যেমন পার্কিং এর জন্য নির্ধারিত স্থান, ফিলিং স্টেশন, হাসপাতাল, পাবলিক টয়লেট, পুলিশ স্টেশন, ফায়ার সার্ভিস, পথচারী পারাপার ইত্যাদি। আবার হাইওয়ে রোডে যে সকল সম্পুরক প্লেট সমূহ থাকে সেগুলোও তথ্যমূলক সাইনের মধ্যে পরে। যেমন বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা গুলো হতে রাজধানী শহর ঢাকার দুরত্ব কতটুকু সেটার কিঃমিঃ এর তথ্য সরবরাহ করে থাকে। সেই সাথে যেসকল এলাকায় দুর্ঘটনার হার বেশী সেসকল এলাকায় দূর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় সম্পূরক সাইনবোর্ড দিয়ে আগাম নির্দেশনা প্রদান করে থাকে। এছাড়াও মসজিদ, মন্দির, গির্জা, সেনানিবাস ইত্যাদি এলাকার প্রবেশমুখে তথ্যমূলক সাইন থাকে।
উপরিক্ত প্রতিটি সাইন বিশেষ গুরুত্ব বহন। আমি আশা করি এগুলোর যথার্থ ব্যবহার আমাদের জীবনকে সড়ক দূর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে যথেষ্ট কার্যকরী হবে। অতএব সড়ক দূর্ঘটনা এড়াতে আমাদের তিনটি পর্যায়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত একজন আদর্শ চালক হতে হলে অবশ্যই আমাকে উপরিক্ত ট্রাফিক নির্দেশনা গুলো সঠিক ভাবে আয়ত্ত করতে হবে, এরপর প্রতিটি বিষয় যথাযথ পালন করতে হবে এবং এমন কিছু না করা যা আমার মনযোগকে বিচ্ছিন্ন করে উদাহরণ স্বরুপ মাদক সেবন, ফোনে কথা বলা বা ফোন ব্যবহার করা ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত সরকারের বা সড়ক বিভাগ কর্তৃপক্ষের কিছু দায়িত্বের বিষয় সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। যেমন: সড়কের ক্রটি গুলো চিহ্নিত করে তার দ্রæত সমাধান করা, ট্রাফিক সাইন গুলো ঠিকঠাক আছে কিনা তা নিশ্চিত করা, প্রতি হাইওয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে যেমন চৌরাস্তা, তিন রাস্তা এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যথাযথ ট্রাফিক পুলিশ নিশ্চিত করা, ট্রেন ক্রসিং এর স্থানে দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ করা, পথচারীদের চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট ফুটপাত, ওভারব্রীজ তৈরি করা, চালকদের লাইসেন্স ক্ষেত্রে যথাযথ পরিক্ষা নিরিক্ষার পর প্রদান করা ইত্যাদি। তৃতীয় এবং সর্বোপরি একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে অবশ্যই আমাকে ট্রাফিক নির্দেশনা গুলো জানা এবং মানা জরুরি। কেননা যখন আমি চালক তখন আমার সচেতনতা পারে আমাকে আমার যাত্রীদের নিরাপদ রাখতে। আবার একজন ব্যক্তি সে পারে নিজেকে এবং তার পরিবারকে রক্ষা করতে। সুতরাং একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে আমরা অবশ্যই চাইবো সড়ক দূর্ঘটনার মতো ভয়ংকর এবং জীবননাশক বিষয় থেকে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে। আমাদের সচেতনতা পারে আমাদের আগাম দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে। আল্লাহ সকলের শুভবুদ্ধি উদয় করুক।