বিশ্বের মোট আয়তনের তিনভাগ জলরাশি হলেও বিশুদ্ধ জল সংকটে ভুগছে ৮০টি দেশের প্রায় ১২০ কোটি মানুষ। এ ছাড়াও প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ১৮ লাখেরও বেশি শিশু প্রাণ হারাচ্ছে শুধুমাত্র দূষিত জল পান করে। বিশুদ্ধ জলের অভাবের নানা কারণও রয়েছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, খরা, ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়া এবং আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। জানা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই বিশ্বের ১৪৫ কোটি মানুষ সুপেয় জল সংকটের মুখোমুখি হবেন। তার মধ্যে এশিয়া মহাদেশে ১২০ কোটি এবং আফ্রিকা মহাদেশে ২৫ কোটি মানুষ এর আওতায় পড়বেন। এর থেকে বাদ যাবেন না বাংলাদেশের মানুষও। বরং তুলনামূলক বাংলাদেশ বেশি জল সংকটে পড়বে। বিশেষ করে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া ও ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ায় বাংলাদেশ বেশি সংকটে পড়বে। যদিও বিদ্যমান এই তিনটি কারণে জলসংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। সেটি আরও ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে গেলে।
জানা গেছে, বিশ্বে মোট মজুত জলের পরিমাণ এক হাজার ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন। তার মধ্যে সমুদ্রে সঞ্চিত লবণাক্ত জলের পরিমাণ ৯৭.২ শতাংশ, যা মোটেই পানযোগ্য নয়। অপরদিকে ২.১৫ শতাংশ জল জমাটবদ্ধ হয়ে আছে বরফাকারে। সেটিও পানযোগ্য নয়। বাকি .৬৫ শতাংশ জল সুপেয় হলেও প্রায় .৩৫ শতাংশ জল রয়েছে ভূগর্ভে, যা উত্তোলনের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন পানযোগ্য জল চাহিদা পূরণ করতে হয়। এটি আমাদের কাছে বিশুদ্ধ জল হিসেবে পরিচিত। এই জলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে প্রতিটি মানুষের জন্যে দৈনিক গড়ে ৩ লিটার হারে। ভূগর্ভস্থ জল ছাড়া নদ-নদী, খাল-বিল কিংবা পুকুর-জলাশয়ের জল সুপেয় হলেও তা বিশুদ্ধ নয়। তবে সেটিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। বিশেষ করে গোসলাদি, রান্না-বান্না, জামা-কাপড় ধোয়ার কাজে এ জলের ব্যাপক প্রয়োজন পড়ে। তাতে করে একজন মানুষের সব মিলিয়ে গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ লিটার জলের প্রয়োজন হয়। শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, গবাদি পশুদের জন্যেও বিশুদ্ধ জলের প্রয়োজন পড়ে। যদিও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কিংবা চরাঞ্চলে গবাদি পশুদের বিশুদ্ধ জল সরবরাহ করা হয় না। শুধুমাত্র খামারের গবাদি পশুদের বিশুদ্ধ জল সরবরাহ করে যত্ন নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রেও প্রচুর জলের প্রয়োজন হয়।
সমগ্র বিশ্বে জল সংকট চরম আকার ধারণ করার ফলে জাতিসংঘ এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মরিস স্ট্রং ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত এক বিশ্ব সম্মেলনে সুপেয় জল সংকটের কথা ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘একুশ শতকে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যায় তবে তার প্রধান ইস্যু হবে জল।’ তার আশঙ্কা যে অমূলক নয়, সেটার প্রমাণও আমরা এরই মধ্যে পেয়ে গেছি। যেমন নীলনদের জলবণ্টন নিয়ে বুরুন্ডি, কঙ্গো, তানজানিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান, মিসর, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, উগান্ডাসহ আরও কয়েকটি দেশ দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। এছাড়াও তানজানিয়া, ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, উগান্ডা নীলনদের জলবণ্টন নিয়ে ‘কো-অপারেটিভ ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন দ্য নীল রিভার বেসিন’ নামক একটি চুক্তি স্বাক্ষরও করেছে। ফলে ওই এলাকায় এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
এ ধরনের আরেকটি দ্বন্দ্বের সংবাদ জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার মধ্যে। কানাডার সাস্কাচেওয়ান প্রদেশে ৮২ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে সুপেয় জলধারা। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের সুপেয় জল চাহিদা মেটাতে কানাডা সরকারের কাছ থেকে জল আমদানি করতে চাইলে কানাডা সরকার তা নাকচ করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে কানাডার জনগণও সরকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে এ নিয়ে কিছু টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে যৎসামান্য দূরত্বও।
সম্প্রতি তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। এর আগে ফারাক্কা বাঁধ নিয়েও কম দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়নি, যার রেশ রয়ে গেছে এখনো। সেই বাঁধের খেসারত আমাদের আজও দিতে হচ্ছে। এখানে লক্ষণীয় যে, বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির অন্তরালে অন্যতম ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবণ্টন। এতে প্রতীয়মান হয়, আগামী শতকে সুপেয় জলই হবে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান হাতিয়ার। সেই হাতিয়ারটাকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকেও। সরকারকে এখুনি আটঘাট বেঁধে নামতে হবে নদী খননের কাজে। নদী-নালা-খাল খননের মাধ্যমে নদীর হারানো নাব্য ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হতে হবে। এতে করে আমাদের সুপেয় জলের ঘাটতি অনেকখানি কমে যাবে এবং তা সংরক্ষণও হবে। কারণ বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ জলস্তর অনেকখানি নিচে নেমে গেছে বেশি বেশি জল উত্তোলনের ফলে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের কথাই ধরা যেতে পারে আগে। এছাড়াও বরেন্দ্র অঞ্চলের জলস্তর মারাত্মকভাবে নিচে নেমে গেছে। ফলে সেচে বিঘ্ন ঘটায় বোরো উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। কাজেই আমাদের সাবধান হতে হবে এখনি। না হলে মেসোপটেমিয়া, ইথিওপিয়ার প্রাচীন সভ্যতার মতো জল সংকটের কারণে বিশ্বের বুক থেকে একদিন হারিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এটি কথার কথা নয়; গবেষণা থেকেই জানা গেছে।
এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশে বিশুদ্ধ জল সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে এরই মধ্যে। প্রায় ৭ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ জল সংকটে ভুগছেন। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ ভুগছেন অতিমাত্রায়। এ সুযোগটি নিচ্ছেন আমাদের দেশের জল ব্যবসায়ীরা। বিশুদ্ধ জলের বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রীতিমতো ট্যাপের জল বোতলে ঢুকিয়ে তা বাজারজাত করে চড়া দামে বিক্রি করছে। যা প্রচার মাধ্যমে বারবার এসেছেও। অথচ বোতলজাত জলের দাম কোনোমতেই এতটা বেশি হওয়ার কথা নয়। ক্ষেত্রবিশেষ দেখা যায় দুধ ও জল প্রায় সমমূল্যে বিক্রি হতে। তারপরও সেই জল নিরাপদ নয়। নিরাপদ জল ভেবে ক্রেতারা তা পান করার ফলে জলবাহিত রোগে ভুগছেন অনেক মানুষ। এ ব্যাপারে প্রশাসনের জরুরি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া বিশুদ্ধ জল পানে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে প্রচার মাধ্যমের সহায়তায়। তাহলে জল জালিয়াতির ঘটনা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবেন জাতি। আর অবশ্যই বোতলজাত জলের নায্যদাম কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে জনসাধারণকে বিশুদ্ধ জল পানে উদ্বুদ্ধ করবেন এ প্রত্যাশা আমাদের। মনে রাখতে হবে জলের দাম যত সহনীয় হবে, ততই বিশুদ্ধ জল পানের দিকে ঝুঁকবেন মানুষ। তাতে জলবাহিত রোগ থেকেও মুক্তি পাবেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, পরিবেশকর্মী