ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ১৯:৫০, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি

তিন বছর পূর্ণ হতে চললেও এখনো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান। ইউক্রেনকে শক্তিশালী দূরপাল্লার ক্রুজ মিসাইল দেওয়ার পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি রাশিয়ার গভীরে ঢুকে আঘাত হানতে সক্ষম। তাই যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের পশ্চিমা মিত্রকে চাপে রাখতে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে নতুন রণকৌশল শানাচ্ছেন বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে পারমাণবিক হাতিয়ার নিয়ে সাামরিক মহড়া শুরু করেছে রুশ বাহিনী। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ইউক্রেনে যুদ্ধ সম্প্রসারণ না করার আহ্বান জানান। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, ফোনালাপে ট্রাম্প পুতিনকে মনে করিয়ে দেন যে, ইউরোপজুড়ে তাদের সামরিক বাহিনীর বিশাল উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্টের এই প্রতিবেদন সম্পূর্ণ অসত্য বলে দাবি করেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। এমনকি তাদের মধ্যে ফোনে কোনো কথা হয়নি বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ২০১৪ সালে রাশিয়ার নিকট ক্রিমিয়া হারানোর পরের বছর বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে রাশিয়ার সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইউক্রেনের সরকারি প্রতিনিধিরা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সেই চুক্তির প্রধান শর্ত ছিল ক্রিমিয়াকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে ইউক্রেন স্বীকৃতি প্রদান করবে। কিন্তু সেই শর্ত পূরণ না করে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য ইউক্রেন প্রচেষ্টা চালায়। এই নিয়ে কয়েক বছর টানাপোড়েন চলার পর ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনীকে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করেন পুতিন। ইউক্রেন এ বিষয়ে একরোখা যে, তাদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা বজায় থাকতে হবে এবং তারা রাশিয়ান সৈন্যদের হটিয়ে দেবে। আর রাশিয়া তাদের অবস্থানে অনড় যে, ইউক্রেন যথাযথ রাষ্ট্র নয় এবং রাশিয়ার লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক অভিযান চলবে। রুশ বাহিনী ২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর যেভাবে বারবার ব্যর্থ হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। রুশ সামরিক বাহিনী উন্নতি করেছে এবং অগ্রসর হচ্ছে বলে একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন।
মার্কিন গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ এখন আর অচলাবস্থা নেই। বরং যুদ্ধে রাশিয়া ধীরে ধীরে অগ্রগতি করছে। ফলে, কিয়েভ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে হাতাশার অনুভূতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউক্রেন পূর্বাঞ্চলে জমি হারাচ্ছে এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে তাদের বাহিনী পিছিয়ে পড়েছে। মনোবল কমে যাওয়া এবং মার্কিন সহায়তা অব্যাহত থাকবে কি-না সে বিষয়ে প্রশ্ন থাকায় ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টার জন্য নিজস্ব হুমকি তৈরি করছে। যুদ্ধে নিহত ইউক্রেনের সৈন্য সংখ্যা প্রায় ৫৭ হাজার। পক্ষান্তরে রাশিয়ার ক্ষতি প্রায় অর্ধেক। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ারও সৈন্য ও সরঞ্জামের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আগামী গ্রীষ্মের আগে ইউক্রেন যদি জোরালোভাবে মার্কিন সমর্থন পায়, তবে রাশিয়ার দুর্বলতাসহ প্রত্যাশিত সৈন্য ও ট্যাংকের ঘাটতির সুবিধা নিতে পারে কিয়েভ। ইউক্রেনীয় সংকটের শুরু থেকে অর্থাৎ ২০১৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের কৌশল হচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে পরাজিত করা। যদিও এরকম হাইব্রিড সংঘাতের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন কিছু নয়। ইরানের বিরুদ্ধে তারা হাইব্রিড সংঘাত ব্যবহার করে। আবার চীনের বিরোধিতা করার জন্য তাইওয়ান এবং এই অঞ্চলে অন্যান্য অংশীদার রাষ্ট্র ফিলিপিন্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানকে ব্যবহার করে। এদিকে ইউক্রেনে জয়ী না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়ার পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে আলোচনার পর উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী চোয়ে সন হুই বলেন, বিজয়ের আগ পর্যন্ত আমরা রাশিয়ার পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াব। ভøাদিমির পুতিনের নেতৃত্ব নিয়ে উত্তর কোরিয়ার কোনো সন্দেহ নেই। সম্প্রতি পারস্পরিক সহযোগিতামূলক চুক্তিও হয়েছে উভয় দেশের মধ্যে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে উত্তর কোরিয়া রাশিয়ায় মোট দশ হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে। উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার যুদ্ধে যোগ দিলে ইউক্রেনের জন্য মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারে নতুন কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে না বলে মার্কিন সেনা সদর দপ্তর পেন্টাগন জানিয়েছে। এদিকে ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ সার্বিক সম্পর্ক জোরদার করতে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করতে যাচ্ছে। ৩১ অক্টোবর মিনস্কে ইউরেশীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন চলাকালীন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এ কথা জানান। তিনি বলেন, এই চুক্তি দুই দেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রসহ আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার জন্য আমাদের পক্ষগুলোর প্রতিশ্রুতির রূপরেখা প্রকাশ করবে। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে সুসংহত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিটি শীঘ্রই চূড়ান্ত হবে। এটি রাশিয়া-ইরান সম্পর্ককে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করবে। চলতি বছরের শেষের দিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান মস্কো সফর করবেন বলে তিনি জানান। ইরানের সঙ্গে চুক্তিটি উত্তর কোরিয়ার অনুরূপ হতে পারে। এর আগেও ইরান রাশিয়াকে ইউক্রেনের যুদ্ধে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে যুদ্ধ করছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সঙ্গে ইসরাইল হামলা-পাল্টা হামলা চলছে, তখনই ইরানের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি সামনে এসেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে এই ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলছে। যেহেতু কোনো দেশই আত্মসমর্পণ করবে বলে মনে হচ্ছে না এবং পুতিনই আবার ক্ষমতায় থাকবেন বলে মনে করা হচ্ছে। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে।
ইউক্রেনে সাংবাদিকদের উদ্দেশে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন বলেন, এটি খুব কঠিন একটি যুদ্ধ এবং এটি খুব কঠিন একটি পরিস্থিতি। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ ফ্রেডেরিক ডব্লিউ কাগান বলেন, রুশরা নিজেদের বিজয়কে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের মতোই অনিবার্য বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। যদিও পরিস্থিতি এমনটি নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার রানিংমেট সিনেটর জেডি ভ্যান্স একটি শান্তি পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন; যেটির সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের প্রস্তাবিত পরিকল্পনার বেশ মিল রয়েছে। পক্ষান্তরে কমলা হ্যারিস লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, যদি রাশিয়াকে ইউক্রেনে থামানো না যায়, তাহলে রুশ বাহিনী ন্যাটোকে আক্রমণ করতে পারে। ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুত্তে বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ৬ লক্ষাধিক রুশ সেনা নিহত বা আহত হয়েছেন। এই ক্ষতির কারণে উত্তর কোরিয়া প্রায় ১০ হাজার সেনা রাশিয়ায় পাঠিয়েছে। তাদের ব্যবহার করে মস্কো ইউক্রেনকে কুরস্ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। চীনা লেখক সান জু বলেন, যুদ্ধ তিন প্রকার। ক) সর্বোত্তম বিকল্প হলো প্রতিপক্ষের পরিকল্পনাকে পরাজিত করা, খ) তার জোটকে পরাজিত করা এবং গ) যুদ্ধের ময়দানে পরাজিত করা। রাশিয়াকে বর্তমানে তিনটি মাত্রায় লড়াই করতে হচ্ছে। রাশিয়া প্রচারণা চালাচ্ছে যে, ইউক্রেনের যুদ্ধ আসলে ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এটি নতুন সৈন্যদের প্রলুব্ধ করছে। যুদ্ধে পশ্চিমা সহায়তাপুষ্ট ইউক্রেন বাহিনী এক সময় বেশ অগ্রগতি দেখিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি তেমন নেই। যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট ফোর্সেসের সাবেক কমান্ডার জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারনসের আশঙ্কা, চলতি বছরেই ইউক্রেন যুদ্ধে পরাজিত হতে পারে। তিনি মনে করেন, ‘একটা পর্যায়ে ইউক্রেন বুঝতে পারবে, তারা এই যুদ্ধে জয় পাবে না। আর সেই পর্যায়ে পৌঁছালে কেনইবা দেশটির মানুষ লড়াই করতে চাইবে? আরও মরতে চাইবে শুধুই অপ্রতিরোধ্যকে প্রতিরোধ করার জন্য?’
রাশিয়ার অগ্রগতি সত্ত্বেও ইউক্রেন মস্কোর বড় কিছু পরিকল্পনা ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে। তারা রাশিয়ার পোকরভস্ক আক্রমণ ব্যর্থ করেছে এবং শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে তাদের বাহিনী সরিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো ইউক্রেনীয় মনে করেন, এখন মনে হচ্ছে মিত্ররা যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এবং ন্যায়বিচারের চেয়ে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কের প্রতি বেশি মনোযোগী। তবে অনেক ইউক্রেনীয় মনে করেন, লড়াই চালিয়ে যাওয়া তাদের একমাত্র উপায়। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধের সম্মুখসারি অনেক দীর্ঘ। এই সম্মুখসারি রক্ষার সক্ষমতা থাকতে হবে ইউক্রেনের। তাদের তা নেই। ফলে, ইউক্রেনীয় বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। রাশিয়াকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো ইউক্রেনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ইউক্রেনকে তারা বিভিন্ন দুঃসাহসিক কাজের জন্য ব্যবহার করবে এবং সম্পদ নিঃশেষ হয়ে গেলে এটি পরিত্যক্ত হবে। পশ্চিমা সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে তারা মূলত তাদের প্রকৃত জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে। ইউক্রেন সরকারও বুঝতে পারছে না, যুক্তরাষ্ট্র্র ও ইউক্রেনের স্বার্থ পৃথক। শেষ পর্যন্ত সে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নও হয়ে যেতে পারে। কিংবা তারা এমনভাবে আটকে পড়েছে; যেখানে তারা যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নিজেদের সকল রাজনৈতিক মূলধন বাজি রেখেছে। ইউক্রেনের অনিবার্য পরাজয় যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তির জন্য আঘাত। তাই এটি এড়াতে ওয়াশিংটন যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। চলমান সংঘাতের যদি কোনো সমাধান না হয়, তাহলে ইউক্রেন পূর্ব ইউরোপের একটি সামরিকায়িত ‘অস্থিতিশীল ছিটমহলে’ রূপান্তরিত হবে। ইউক্রেনীয় ফ্রন্ট যদি ভেঙে যায়, সেক্ষেত্রে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার মন্তব্য করেছেন, রাশিয়াই ইউক্রেনে সংঘাত শুরু করেছে এবং তারা চাইলে এখনই তা বন্ধ করতে পারে। রাশিয়ার দিকে পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়াকে যুদ্ধের গুরুতর বিস্তার হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলে পুতিনের হুঁশিয়ারির পর তিনি এমন মন্তব্য করেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে আরও উত্তেজনা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের উপ-চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যদি এই সংঘাত জিইয়ে রাখার পদক্ষেপ অব্যাহত রাখেন, তবে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের দিকে এগোনোর ঝুঁকি বাড়বে। তিনি মার্কিনিদের উদ্দেশ করে বলেন, তারা যদি মনে করে রাশিয়া তার নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে, তবে তারা মস্ত বড় ভুলের মধ্যে বাস করছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল হচ্ছে, রাশিয়াকে এমন কিছু অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ গ্রহণে চাপ প্রয়োগ করা; যা রাশিয়ার পরিকল্পনাকে বিপর্যস্ত করবে এবং মস্কোপন্থি জোটগুলোকে ধ্বংস করে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত উত্তেজনা বৃদ্ধির উপায় খুঁজবে এবং রাশিয়াকে উত্তেজনার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠাবে। তবে এমন পরিস্থিতিতেও রাশিয়া আন্তর্জাতিক বিষয়ে যে দৃঢ় অবস্থান নিচ্ছে; তা তাদের আস্থা ও শক্তির বহির্প্রকাশ। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, বন্ধু রাষ্ট্র ভারত, চীন ও ব্রাজিল চাইলে ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে। প্রায় তিন বছর হতে চললেও যুদ্ধ থামাতে কোনো মধ্যস্থতাই এখন পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। পুতিন বলেন, এ লড়াই থেমে যেত অনেক আগেই। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ শুরু করিনি, পশ্চিমা দেশগুলো অস্ত্র সহায়তা দিয়ে এটি জিইয়ে রেখেছে। আমরা শুধু চাই ইউক্রেন সরকার রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করুক, রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় আসুক এবং ইউক্রেনের জনগণের ভবিষ্যৎকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানের সঙ্গে এক সাক্ষাতে পুতিন বলেন, তার দেশ সাময়িক যুদ্ধবিরতি নয় বরং ইউক্রেন যুদ্ধের পুরোপুরি অবসান চায়। পুতিন অভিযোগ করে বলেন, ইউক্রেন সরকার সাময়িক যুদ্ধবিরতির সুযোগে নিজের ক্ষতি পুষিয়ে নতুন উদ্যমে আবার যুদ্ধ শুরু করার পরিকল্পনা করছে। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধ শেষ করার আগে ডনবাস অঞ্চলের পাশাপাশি ঝাপোরেজিয়া ও খেরসন অঞ্চল থেকে ইউক্রেনের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে। কারণ হিসেবে তিনি ওই অঞ্চলগুলো গণভোটের ভিত্তিতে রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলে জানান। ক্রেমলিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এবং অন্য কূটনীতিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে পুতিন বলেন, আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির সংলাপ শুরুর জন্য নতুন দুটি শর্ত প্রদান করেন পুতিন। প্রথমটি হলো, ইউক্রেনের যে চার প্রদেশ রাশিয়া নিজের সীমানাভুক্ত করেছে, সেই প্রদেশগুলো থেকে নিজেদের সেনা সরিয়ে নিতে হবে কিয়েভকে। দ্বিতীয়টি হলো, ইউক্রেনকে অবশ্যই ঘোষণা করতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের জোট ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আর তদবির করবে না কিয়েভ। আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলদিমির জেলেনস্কি মন্তব্য করেন, মস্কো যদি পুরো ইউক্রেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, কিয়েভ আগামীকালই রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। তিনি এটিও বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ থামাবেন না। তাই, সামরিক হোক আর কূটনৈতিক উপায়ে হোক, যেকোনো মূল্যে যুদ্ধ থামাতে হবে। তবে যুদ্ধে জয়ী হতে শুধু পশ্চিমা সহায়তাই যথেষ্ট নয়। ইউক্রেনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন দুর্বল হয়নি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা থিংকট্যাংক গ্লোবসেকের পর্যালোচনা অনুযায়ী, প্রথম সম্ভাব্য ফল হলো, ২০২৫ সালের বেশি সময় পর্যন্ত যুদ্ধটা দীর্ঘায়িত হবে। এতে দুপক্ষেরই ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটবে এবং ইউক্রেন মিত্রদের অস্ত্র সহায়তার ওপর নির্ভর করবে। দ্বিতীয় সম্ভাব্য ফল হলো, বিশে^র অন্যান্য অংশের সংঘাত বৃদ্ধি পাবে। যেমনÑ মধ্যপ্রাচ্য, চীন-তাইওয়ান এবং বলকানদের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়বে। তৃতীয় সম্ভাব্য ফল হলো, ইউক্রেন সামরিক দিক থেকে কিছুটা অগ্রসর হবে। কিন্তু যুদ্ধ শেষ করার মতো পরিস্থিতিতে যেতে পারবে না। চতুর্থ সম্ভাব্য ফল হলো, ইউক্রেনের মিত্রদের সমর্থন ফুরিয়ে আসবে এবং তারা একটি সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। ক্রেমলিনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ এখন সবচেয়ে কঠিন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ক্রেমলিন জানিয়েছিল, রাশিয়া ‘পরমাণু নীতি’ পাল্টে ফেলবে। এমনকি যে দেশগুলোর নিকট আণবিক অস্ত্র নেই, তাদেরও আক্রমণ করা হবে; যা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশে^র নিকট চূড়ান্ত সতর্কতা হবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েই আমরা পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার করব। এখনই আমরা এটা করতে চাই না। কিন্তু আমরা সবদিক থেকে প্রস্তুত থাকতে চাই। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরমাণু অস্ত্রের সামরিক মহড়া দিয়ে ইউক্রেন ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে সরাসরি হুমকি দিয়েছে রাশিয়া। এর ফলে ইউক্রেন থেকেই তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করছে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×