বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ‘গত বছরের আগস্ট মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৫৪ শতাংশে। এটি দেশে গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।’ তাদের মতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভুল নীতি, ভুল পদক্ষেপ এবং সেই সঙ্গে বাজারের ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ঠেকানো যায়নি। এর ফলে, মুদ্রা সংকটের অবস্থা আরও চরমে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকটের অন্যতম কারণ হলো, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সংকীর্ণ পথ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অন্য দেশের তুলনায় অনেক অগ্রগামী। কিন্তু ইদানীং রপ্তানির সন্তোষজনক অবস্থা দেখা যাচ্ছে না। বিগত কয়েক বছর ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের যে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি চলছে, তাতে জনজীবন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেশে প্রতি ঘণ্টায়, এমনকি প্রতি মুহূর্তে জিনিসপত্রের মূল্য বেড়েই চলছে। যাদের কাঁধে সোনার ফসল ফলানোর দায়ভার, সেই গ্রাম্য চাষিরাও আজ দুবেলা দুমুঠো ভাতের সন্ধান করতে পারছেন না। তাদের অনেকেরই আবার নুন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছে। এখানে কেবল বিত্তবানদের অস্তিত্বই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বল্প আয়ের লোকেরা দরিদ্র থেকে অতি দরিদ্রে পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশ এদিকে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সনির্ভর হওয়া সত্ত্বেও এখন সেটা খুবই আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এমনকি চরম অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কাসহ অধিকাংশ দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হলেও বাংলাদেশের ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) বেড়েই চলেছে। অনেকের ধারণা, সরকার পতনের পর থেকে দেশের অর্থনীতিতে ভঙ্গুর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবে দুর্বল অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী নন। ফলে, বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। আর্থিক খাত সংস্কারের আশায় দিন গুনছে ব্যাংকার, ব্যবসায়ী আর বিশ্লেষকরা।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান জানান, ব্যাংকগুলো নতুন এলসি খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। যেসব রপ্তানিকারকের ডলার এ্যাকাউন্টে জমা আছে, তারা শুধু আমদানির দায় পরিশোধ করতে পারছেন। এর বাইরে যারা ব্যাংক থেকে ডলার কিনে আমদানি বিল পরিশোধের চিন্তা করছেন, তারা সবাই ফিরে যাচ্ছেন। কারণ, বেশিরভাগ ব্যাংকের কাছে ডলার জমা নেই। অন্যদিকে, যাদের কাছে আছে, তারা ভবিষ্যৎ আমদানি পেমেন্টের কথা চিন্তা করে ডলার খরচ করছেন না। ফলে, বাজার অর্থনীতিতে মুদ্রা সংকটের বিদ্যমান অবস্থা জনজীবনে দুর্ভোগ ডেকে আনছে।
বিগত বছরের আমদানির বকেয়া বিল পরিশোধ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কিছুদিন রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ ছিল। এসব কারণে খোলাবাজারে ডলারের সরবরাহ ছিল না।
তবে সরকার নীতিগত পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন করায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটির ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের ঢাকা সফর শেষে এক বিবৃতিতে আইএমএফ জানিয়েছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। আইএমএফের সহযোগিতায় অন্তর্বর্তী সরকার নতুন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। আশা করা হচ্ছে আর্থিক খাতে আবার স্বস্তি ফিরে আসবে। ব্যাংকের পাশাপাশি খোলা বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না মার্কিন মুদ্রা। তবে এদিকে ডলার সংকট নিরসনে আশার আলো দেখাচ্ছে রেমিট্যান্সপ্রবাহ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সরকার পতনের পর থেকে দেশে বৈধপথে রেমিট্যান্স আসার গতি বাড়তে শুরু করেছে। সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে প্রায় ৪০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। আর প্রতিদিন রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে ৯২৭ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, ‘চলতি বছরের অক্টোবর মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলার আসছে। তবে পুরো মাসে এসেছে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বেশি। এদিকে গত সেপ্টেম্বর মাসের পুরো সময়ে ২০০ কোটি ৪৮ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিকরা। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ২৮ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকার বেশি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে ১৯০ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স আসে। তবে গত অক্টোবর মাসে প্রবাসী আয়ের গতি ঊর্ধ্বমুখী ছিল। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। বর্তমানে রেমিট্যান্সপ্রবাহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং একই সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আশার আলো দেখাচ্ছে।
আশার আলো রেমিটেন্স প্রবাহ
শীর্ষ সংবাদ: