শিক্ষার দ্বারা একটি জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সংস্কৃতিক বিপ্লব সাধিত হয়। শিক্ষার বীজ বপন এর মাধ্যমে একটি জাতির ভিত্তি স্থাপিত হয়। জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ, জাতীয় উন্নয়ন, ঐক্য সংহতি জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ, সামাজিক ন্যায় বিচার, সাম্য, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, আদর্শের ভিত্তিতে চরিত্র গঠন এবং সৎ নাগরিক ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি ইত্যাদি সকল কিছু আবর্তিত হয় কেবল শিক্ষাকে ঘিরে এবং সেটি একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা একটি দেশ ও জাতির মৌলিক জীবনবোধ, সামাজিক রীতিনীতি সংস্কৃতি - কৃষ্টি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও দর্শনের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। শিক্ষা হল প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষকে তার পরিবেশে ও সমাজে সক্রিয় ভ‚মিকা পালনের জন্য দীক্ষা ও প্রস্তুতির একটি প্রক্রিয়া। জন মিলটন বলেছেন," ঊফঁপধঃরড়হ রং ঃযব যধৎসড়হরড়ঁং ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ড়ভ সরহফ ংড়ঁষ" এই একই কথাকে একটু ঘুরিয়ে বলেছেন এরিস্টটল, তার মতে, সুন্দর মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা। আর সক্রেটিসের ভাষায় শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।
শিক্ষা ও উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। একটি মূলত নির্ভর করে শিক্ষার ধরন পদ্ধতি এবং ব্যক্তি সমাজ ও মানবতার প্রয়াস মেটানোর প্রত্যাশা পূরণের সামর্থের উপরে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াসের অন্যতম একটি দিক হলো প্রতিটি ব্যক্তির স্বনির্ভরতা অর্জন নিশ্চিত করা। আর এই স্বনির্ভরতা তখনই আসবে যখন শিক্ষা ও উন্নয়ন একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কাজেই ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে জনকেন্দ্রিক উন্নয়নের কৌশল অব্যাহত রাখতে হবে। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের চর্চায় পৃথিবী প্রতিনিয়তই চমকপ্রদ সব উন্নয়নের সাক্ষী হচ্ছে। ডেটা সায়েন্স, মেশিন লার্নিং, ক্লাউড কম্পিউটিং, রোবটিক্স টেকনোলজি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বিভিন্ন কাজে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি, বিভিন্ন শাখায় উত্তরোত্তর দক্ষ জনবলের চাহিদা বৃদ্ধি লক্ষণীয়। আবার, বাংলাদেশ সহ বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন প্রাকৃতিক সম্পদের হ্রাস,দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি নানা কারণে পুরো পৃথিবীতে এক জটিল অবস্থা বিরাজ করছে। এখন প্রশ্ন হল, এগুলো কেন হচ্ছে? উত্তর একটাই পরিমিত শিক্ষার অভাব, ও ভুল শিক্ষা ব্যবস্থা। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর সকল সৃষ্টির চলার পথ জন্য আল্লাহ রব্বুল আলামিন কর্তৃক তাদের স্ব স্ব সৃষ্টির কাঠামোর মধ্যে গ্রোথিত করায় তাদের শিক্ষার কোন প্রয়োজন নেই। আর এ কারণেই তাদের চলার পথে নেই কোন পরিবর্তন, বিশৃঙ্খলা কিংবা বিদ্রোহ। মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য দেওয়া হলেও জ্ঞানচর্চা মহান প্রভুর একটি বিশেষ দান। মানুষের চলার পথ যেহেতু আল্লাহর আনুগত্যের সাথে সম্পৃক্ত তাই সে বিষয়ে জ্ঞান অর্জন অত্যাবশ্যক। আর এই জ্ঞান অর্জনের উপায় হলো শিক্ষা লাভ করা।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত উপমহাদেশের মুসলিম, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলের শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমবিবর্তনের ফল। নানা কারণে এদেশের মুসলিমরা উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে ছিল এর প্রধাণ কারণ হিসেবে ধরা হয় দামেস্ক ও সিন্ধুতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। পরবর্তীতে জাতির ভারত আক্রমণ কেবল সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয় শিক্ষা ক্ষেত্রে ও যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল বিজিত এলাকায় জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বহু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভারতের মুসলিম শাসকদের শিক্ষার প্রতি অনুরাগ সম্পর্কে ড.এ.আর. মল্লিক বলেন, ভারতের সকল মুসলিম শাসকই রাজ্যের সর্বত্র অসংখ্য মক্তব মাদ্রাসা স্কুল কলেজ ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্টা করেছিলেন এবং সর্ববিধ উপায়ে শিক্ষা বিস্তারে তৎপর ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনামলে ১১ টি শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষানীতি ছিল এর মধ্যে প্রধান হলো ১৮৩৫ সালের লর্ড মেকলে শিক্ষা বিষয়ক প্রতিবেদন। পাকিস্তান আমলে ছয়টি এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ছয়টি শিক্ষা কমিটি প্রণয়ন করা হলেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। সবশেষ, ২০২২ সালে প্রণীত শিক্ষানীতির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক। বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় কল্পনার ঘাটতি ছিল। অভাব ছিল সমন্বয়ের। এছাড়াও রয়েছে ধর্ম বিমুখতা। এদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মকে ঐচ্ছিক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ফলে দুর্নীতির সয়লাব চলছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শিক্ষার সমস্ত কাঠামো পরিকল্পনা ও অনুশীলনকে নির্দেশনা ও সমন্বয় সাধনের জন্য প্রয়োজন নীতি, যার মাধ্যমে শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্যসমূহ অর্জন করা যায়। একটি সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় নি¤œরূপÑ
আধুনিক পাঠ্যক্রম: যুগোপযোগী ও দক্ষতা ভিত্তিক পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা যা শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
প্রযুক্তির সংযুক্তি: শিক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা, যেমন অনলাইন পাঠদান, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, এবং ভার্চুয়াল ল্যাব।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম এবং কর্মশালা চালু করা যা তাদের আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করবে।
মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন: পরীক্ষা-নির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও প্রকল্প ভিত্তিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা।
প্রায়োগিক শিক্ষা: পাঠ্যসূচিতে বেশি বেশি প্রায়োগিক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা যাতে শিক্ষার্থীরা তাত্তি¡ক জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারে।
বৃত্তিমূলক শিক্ষা: শিক্ষার মধ্যে বৃত্তিমূলক কোর্স এবং প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা, যা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কর্মমুখী দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করবে।
শিক্ষায় সাম্যতা: সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, যাতে অর্থনৈতিক বা সামাজিক কারণে কেউ পিছিয়ে না পড়ে।
এগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে শিক্ষা ও উন্নয়ন অনেকাংশেই একে অপরের পরিপূরক হতে পারেÑ এমনটি আশা করা যায়।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়