বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে আমাদের জীবন সহজতর হয়েছে, তথ্য প্রাপ্তি এবং ছড়ানোর ক্ষেত্রে গতিশীলতা এসেছে। তবে এই সুবিধার পাশাপাশি একটি বড় চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছেÑ অপপ্রচার। একসময় তথ্যের উৎস ছিল কেবলমাত্র সংবাদপত্র, রেডিও, বা টেলিভিশন, যেখানে তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সরবরাহ করা হত। কিন্তু বর্তমানে যে কেউ সামাজিক মাধ্যমে কোনো খবর বা তথ্য পোস্ট করতে পারে, যা দ্রæত অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। এর ফলে কোনো তথ্য সঠিক না হলেও তা বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। অপপ্রচার আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক বন্ধন এমনকি পুরো সমাজের উপরেও প্রভাব ফেলতে পারে। অপপ্রচার রোধে সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি, কারণ অপপ্রচার কখনোই একটি নির্দিষ্ট সীমানায় আটকে থাকে না। একবার কোনো মিথ্যা তথ্য বা বিভ্রান্তিকর খবর ছড়িয়ে গেলে সেটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না; বরং পুরো সমাজেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সাধারণ মানুষের জন্য যা বোঝা কঠিন হয়ে যায় যে, কোন তথ্যটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা। আর এ কারণেই অপপ্রচার খুব সহজেই মানুষের মধ্যে উত্তেজনা, আতঙ্ক এবং সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে।
অপপ্রচার অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবেই ছড়ানো হয়, যাতে সমাজের কোনো নির্দিষ্ট অংশ বা গোষ্ঠীকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ধর্ম, জাতি, কিংবা রাজনীতির ক্ষেত্রে অপপ্রচার খুব সহজেই মানসিক এবং পারস্পরিক বিদ্বেষ তৈরি করতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে অপপ্রচার চালানো হলে সমাজে বিভেদ এবং অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে সা¤প্রদায়িক সংঘাত, ধর্মীয় বিভাজন, বা জাতিগত বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের অপপ্রচারের কারণে সমাজে শান্তি বিনষ্ট হয় এবং সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়েও অপপ্রচারের নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মিথ্যা তথ্য বা গুজব রটানো এখন সাধারণ একটি ঘটনা। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালালে তার মানসিক এবং সামাজিক জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। অনেক সময় অপপ্রচারের কারণে ব্যক্তিগত জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর ফলে একদিকে যেমন একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি সমাজে মানুষে মানুষে বিশ্বাস এবং আস্থার অভাব দেখা দেয়।
অপপ্রচারের কুপ্রভাব থেকে বাঁচতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সচেতনতা। একজন সচেতন মানুষ অপপ্রচারের শিকার হলেও সে সহজে বিভ্রান্ত হয় না। তথ্যের সত্যতা যাচাই করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। তথ্য সত্য না হলে বা যাচাই করা না গেলে তা থেকে বিরত থাকতে হবে। তথ্য যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র বা গণমাধ্যমের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। যেমন, কোনো তথ্য প্রথমে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা কোনো নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে কিনা, তা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। শিক্ষা এবং সচেতনতা অপপ্রচার রোধে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। শিক্ষা মানুষকে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শেখায়। একটি সুশিক্ষিত সমাজে অপপ্রচার সহজে প্রভাব ফেলতে পারে না। কারণ শিক্ষিত মানুষ নিজে থেকে তথ্য যাচাই করে দেখে এবং মিথ্যা তথ্যকে অবিশ্বাস করতে শিখে। মিডিয়া লিটারেসি, অর্থাৎ গণমাধ্যম সম্পর্কে সচেতনতা শিক্ষার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই তথ্য যাচাইয়ের গুরুত্ব বুঝতে শিখবে।
বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য পাওয়া সহজ হলেও তথ্য যাচাই করার অভ্যাস এখনও গড়ে ওঠেনি। অনেক মানুষ এখনো ইন্টারনেটে পাওয়া যেকোনো তথ্যকে সত্য বলে ধরে নেয়। এ ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যম এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের সচেতন করার পাশাপাশি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে। সামাজিক মাধ্যমগুলোর উচিত সন্দেহজনক খবর বা গুজব সনাক্ত করে তা দ্রæত সরিয়ে নেওয়া। অনেক সময় সামাজিক মাধ্যম কর্তৃপক্ষ অপপ্রচার রোধে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। তবে তা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। প্রযুক্তিগত দিক থেকে অপপ্রচার রোধে আরও উন্নত পদ্ধতির প্রয়োজন রয়েছে। গণমাধ্যমকেও অপপ্রচার রোধে ভ‚মিকা রাখতে হবে। গণমাধ্যমে যে তথ্য প্রকাশিত হয় তা মানুষের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করে। অপপ্রচার রোধে নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো ভুল বা মিথ্যা তথ্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে তা মানুষের মধ্যে দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভ্রান্তি তৈরি করে। তাই গণমাধ্যমের উচিত যথাযথভাবে তথ্য যাচাই করে তা প্রকাশ করা। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও গণমাধ্যমের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। মানুষকে শেখাতে হবে যে, কোন খবরটি বিশ্বাসযোগ্য এবং কোনটি নয়।
অপপ্রচার রোধে আইনি ব্যবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। অনেক দেশে মিথ্যা তথ্য বা অপপ্রচার ছড়ানোর জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। অপপ্রচারকারী ব্যক্তিদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করলে কেউ সহজে অপপ্রচারে লিপ্ত হতে চাইবে না। একইসাথে, আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে অপপ্রচার প্রতিরোধ করার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। অপপ্রচার রোধে ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিটি মানুষকে নিজ দায়িত্বে তথ্য যাচাই করতে হবে। কোনো তথ্য যাচাই না করে তা অন্যের সাথে শেয়ার করলে তা দ্রæত বড় আকার ধারণ করে। তাই সামাজিক মাধ্যমে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ কোনো তথ্য শেয়ার করার আগে তা যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি। সচেতনভাবে যাচাই-বাছাই না করলে সমাজে ভুল তথ্য প্রচারিত হয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। বর্তমান বিশ্বে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের কারণে অপপ্রচার প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সনাক্ত করে তা সরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এতে করে অপপ্রচারের গতি কমানো সম্ভব হতে পারে।
অপপ্রচার রোধে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে। পাশাপাশি, সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। অপপ্রচার রোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। প্রত্যেকের উচিত তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস তৈরি করা এবং মিথ্যা তথ্যকে প্রতিরোধ করা। এটি একদিকে যেমন সমাজের জন্য মঙ্গলজনক, তেমনি সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায়ও অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ