এমন এক সময় ছিল যখন এলাকায় একজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেলে তাকে সবাই দেখতে আসত। সংবাদপত্র, টেলিভিশন সাংবাদিকরা আসত সাক্ষাৎকার নিতে। কিভাবে সে পড়ল, তার এত দূর আসার অনুপ্রেরণা কে। আরও কত কি প্রশ্ন। পত্রিকা ও টেলিভিশনে বড় করে হেডলাইনে জিপিএ-৫ ধারীদের ছবি ছাপা হতো। এগুলো আমার দেখা নয়, বাবা-দাদাদের থেকে শুনা কথা। কালের বিবর্তনে আজ জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যা লাখ লাখ। তাই আজ আর কেউ জিপিএ-৫ পেলে তার বাসায় সাংবাদিক আসে না। তাকে টিভি কিংবা পত্রিকায়ও ছাপায় না। যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সবাই জিপিএ-৫ পায়, তাহলে আমরা গর্ব করতে পারতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এমন অনেক জিপিএ-৫ ধারী রয়েছে জিপিএ-এর পূর্ণরূপ জানে না। প্রকৃতপক্ষে অনেক জিপিএ-৫ ধারী জিপিএ-৫ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু করোনা কিংবা বিভিন্ন কারণ বশত তাকে জিপিএ-৫ পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে এসে এই এ প্লাসধারী কতটুকু যোগ্যতার সাক্ষ্য রাখতে পারছে?
আমার দেখা একটি সত্য ঘটনা উল্লেখ করা যাক। পাশের বাড়িতে একজন দাদা ছিলেন। তিনি খুব সম্ভবত দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, তিনি এতটাই জ্ঞানী ছিলেন যে কোনো ইংরেজী শব্দের অর্থ বলে দিতে পারতেন নিমিষেই। পাশাপাশি ইংরেজিসহ সকল বিষয়ে তার দক্ষতা সবাইকে অবাক করত। ছোট থাকাকালীন সময়ে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তার সান্নিধ্যে আসার। একদিন মজা করে অনেক ইংরেজি শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করেছিলাম। প্রত্যেকটি শব্দের সঠিক উত্তর পেয়ে আমি অবাক হই। অথচ এই শব্দগুলোর উত্তর এখনকার অনার্স সম্পূর্ণ করা অনেক শিক্ষার্থী দিতে ব্যর্থ হবে। তাহলে বোঝা যায় তখনকার সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থা আর বর্তমান সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থার পার্থক্য। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কি আমাদের এই অবস্থা কাম্য ছিল! নাকি তথ্য প্রযুক্তি সম্মিলিত এই যুগে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আরও আধুনিক হওয়া প্রয়োজন ছিল?
সম্প্রতি প্রকাশিত হলো ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফল। এবার এইচএসসিতে গড় পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮। যদিও গতবার বিবেচনায় পাসের হার কমেছে, কিন্তু বেড়েছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ভালো ফল পাওয়ায় আনন্দ-উল্লাসে ভাসছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। তবে তাদের আকাশে চিন্তার মেঘও জমতে শুরু করেছে। কেননা, কিছুদিন পরই শুরু হবে ভর্তিযুদ্ধ। আর এতে জিপিএ-৫ পেয়েও অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৩৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন রয়েছে ৩৯ হাজারের বেশি। আর এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী। ফলে, জিপিএ-৫ পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। তাছাড়া প্রতিবছর পরীক্ষায় পাস করে প্রায় ১০-১২ লাখ শিক্ষার্থী। কিন্তু, পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে আসন রয়েছে ৪ লাখের কিছু বেশি। ফলে, এক্ষেত্রেও বঞ্চিত হবে শিক্ষার্থীরা।
প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেয়ে পাস করার পর এই তরুণরা যখন চাকরির বাজারে প্রবেশ করে তখন তারা বুঝতে পারে এই জিপিএ-৫ এর মূল্য কতটুকু। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায়, স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার। ঐ প্রতিষ্ঠানের মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান এবং মাত্র ৩ শতাংশ স্বউদ্যোগে কিছু করছেন। দুই বছর আগেও বিশ্বব্যাংক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ করেছিল। তাতেও দেখা গেছে, স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীদের ৪৬ শতাংশ বেকার, যারা তিনবছর ধরে চাকরি খুঁজছেন। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণায় দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার বলে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। এই গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি, যেখানে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। অন্যদিকে দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছেন ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে, বড় একটি অংশ বেকার থেকে যাচ্ছে। তাছাড়া, করোনায় দাপটে কাজ হারিয়েছে অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ। গোটা বিশ্বেও শিক্ষিত বেকার মানব সম্পদ নেহায়েত কম নয়। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-ট্রেন্ডস ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এক তথ্যে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির বছর বিশ্বে বেকার মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২০ কোটি ৭০ লাখ। এই সংখ্যা করোনা মহামারি শুরুর আগের বছর ২০১৯ সালের চেয়ে ২ কোটি ১০ লাখ বেশি।
দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের হার যেমন বাড়ছে, তেমন উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীর কাছে চাকরি হয়ে উঠেছে ‘সোনার হরিণ’। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাসহ সংশ্নিষ্টরা বলছেন, প্রধানত শিক্ষার নিম্নমানই এর জন্য দায়ী। মানহীনতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষ জনবলের ঘাটতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষা দিতে না পারা ও শিক্ষায় কম বিনিয়োগ ইত্যাদি এর কারণ। ‘বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সে অনুযায়ী দেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। শ্রমবাজারের তুলনায় চাকরির বাজার ছোট হওয়ায় সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরাও চাকরি পাচ্ছেন না। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বেকারত্ব কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের চিত্র অনেকটাই বিপরীত। এ দেশে শিক্ষিতের বেকার হওয়ার আশঙ্কা অশিক্ষিতদের তুলনায় বেশি। কারণ, অশিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী যে কোনো কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু শিক্ষিত একজন তরুণ চাইলেই যে কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই শিক্ষিত জনশক্তির জন্য কর্মসংস্থান বর্তমান একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখনই সময় শিক্ষা ব্যবস্থায় লাগাম টানার। পাস কিংবা জিপিএ মুখ্য নয়, বরং প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন প্রকৃত শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী হয়ে উঠতে পারে, সেটি আমাদের বড় লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি সর্বক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে সকল শিক্ষার্থী কারিগরি দিকে যেতে ইচ্ছুক, তাদের সেই দিকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সৃজনশীল করতে হবে। জীবনকে গড়তে শিক্ষার বিকল্প নেই। কিন্তু সেই শিক্ষা যেন হয় সুশিক্ষা তথা আলোকময় শিক্ষা। আমরা যেন সেই শিক্ষা নিয়ে গর্বের সুরে বলতে পারি, আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। আর তাহলেই শিক্ষাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ