আমাদের জীবনে রাত বা রজনী অংশটি খুব কম সময় নয়। দিবসের অর্ধেক, জীবনের অর্ধেক। তবে দিবসের একটি অংশ আলোয় ভরা আরেকটি অংশে নেমে আসে নিকষ অন্ধকার। এটি খোদারই দেওয়া এবং তাঁর নিয়মমতোই এ কৃষ্ণ অংশ ব্যবহার করতে হবে। দিন শুরু হয় ফজরের সালাতের মধ্য দিয়ে। আর রাত নামে মাগরিবের সালাত নিয়ে। ঘুমানোর অভ্যাস আমাদের একেক জনের একেক রকম। ঘেউ ঘুমাতে চায় সন্ধ্যারাতে কেউবা মাঝরাতে আবার কেউ শেষরাতে। কিন্তু ঘুমানোর এই অভ্যাসের ওপর শরীরের অনেক কিছুর পরিবর্তন নির্ভর করে। বিশেষ করে দেরি করে ঘুমাতে গেলে আমাদের শরীরের ভেতরে বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়, পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়ার ধরনেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। ফলে হার্টের ক্ষতি হয়। শুধু তাই নয়, দেরি করে ঘুমাতে যাওয়া এবং সকাল ৭ থেকে ৮টার মধ্যে উঠে যাওয়ার কারণে ঘুমের কোটা সম্পন্ন হয় না। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায় বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা অভিমত ব্যক্ত করেন।
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সঙ্গে নিশিরাতের এক প্রাকৃতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। আপনি শরীরে প্রেসার দিয়ে ঘুমাচ্ছেন না ঠিকই, আপনার ব্রেন, চোখ কিন্তু বিদ্রোহ করেই চলেছে। যা আপনি বুঝতে পারছেন না। কারণ গভীর রাতে মস্তিষ্ক একান্ত বিশ্রাম গ্রহণ ছাড়া আপনার সার্ভিস দিতে রাজি নয়। অন্ধকার রাত তার মধ্যে এক ধরনের মাদকতা স্থবিরতা নিয়ে আসে। এটি মানুষের জন্য অনেক বড় নেয়ামত। দিনেরবেলা যা তার কর্মক্ষমতাকে সচল রাখে। সুতরাং চোখ এবং ব্রেনকে রাতের ১১ টা ১২ টার পর থেকে ব্যবহার করলে তা জীবনে বড় ধরনের ক্ষতির দিকেই ধাবিত করে।
বর্তমান অস্থিরতার যুগ। ফেসবুকের যুগ। মানুষ সারাদিনের নানান প্রশ্নের উত্তর রাতেরভাগেও মিলিয়ে শেষ করতে পারে না। তাই ঘুমের অংশে সে যত সব মেশিনারিজ, মোবাইল, ইন্টারনেট নিয়ে বসে থাকে। যা একান্ত আত্মঘাতী। মোবাইলের যে আলো বা রশ্মি তা কখনো শরীরের অনুকূলে নয়। রাতের ঘুমের অংশে হলেও এসব ব্যবহার থেকে দূরে থাকা উচিত। বিজ্ঞান বলছে, মোবাইল শুধু পাশে রেখে ঘুমানো ক্ষতিকর নয়; পায়ের পাশে রাখলেও তার অশেষ ক্ষতিকর শক্তি শরীরের জন্য মারাত্মক রোগব্যাধি নিয়ে আসে।
ঘুমানোর আদব প্রসঙ্গে : মুসলিম ব্যক্তি মনে করে ঘুম অন্যতম নিয়ামত, যার দ্বারা আল্লাহতা‘আলা তাঁর বান্দাগণের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহতা’আলা বলেন: তিনিই তাঁর দয়ায় তোমাদের জন্য করেছেন রাত ও দিন, যেন তাতে তোমরা বিশ্রাম করতে পার এবং তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার। আরও যেন তোমরা কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করতে পার। আল্লাহতা’আলা আরও বলেন : ওয়াজাআল না নাউমাকুম সুবাতাÑ ‘আর তোমাদের ঘুমকে করেছি বিশ্রাম।’- (সূরা নাবা)। কারণ, দিনের কর্মব্যস্ততার পর রাতেরবেলায় বান্দার বিশ্রাম তার শারীরিক প্রাণচাঞ্চল্যতা, প্রবৃদ্ধি ও উদ্যমের জন্য সহায়তা করে, যাতে সে তার কর্তব্য পালন করতে পারে, যার জন্য তাকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এ নিয়ামতের কৃতজ্ঞতার বিষয়টি মুসলিম ব্যক্তির কাছে জরুরি ভিত্তিতে দাবি করে, সে যাতে তার ঘুমানোর ব্যাপারে নিম্নোক্ত আদবসমূহের প্রতি লক্ষ্য রাখে:
১. ‘ইলমী আলোচনা, অথবা মেহমানের সৌজন্যে কথপোকথন, অথবা পরিবারের দেখাশোনার মতো কোনো জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এশার সালাতের পর তার ঘুমকে বিলম্বিত না করা। কেননা, আবু বারযা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হাদিস বর্ণনা করেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার সালাতের পূর্বে ঘুমানো এবং তার (এশার সালাতের) পরে কথা বলা অপছন্দ করতেন।’
২. অযু করা ছাড়া না ঘুমানোর চেষ্টা করা।
৩. ঘুমানোর শুরুতে তার ডান কাতে শুয়ে পড়া এবং তার ডানপাশকে বালিশরূপে ব্যবহার করা। আর পরবর্তীতে (ডান কাত থেকে) নিজেকে বাম কাতে পরিবর্তন করাতে কোনো দোষ নেই। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে উদ্দেশ্য করে বলেন: ‘যখন তুমি ঘুমাতে যাবে, তখন অযু করে নাও, যেমনিভাবে তুমি সালাত আদায়ের জন্য অযু করে থাক। অতঃপর ডান কাতে শুয়ে পড়ো।’ তিনি আরও বলেন: তুমি যখন পবিত্র অবস্থায় তোমার বিছানা গ্রহণ করবে, তখন তুমি তোমার ডানপাশকে বালিশরূপে গ্রহণ কর।’ (আবু দাউদ, ৫০৪৯)।
৪. রাত অথবা দিনে ঘুমানোর সময় উপুর হয়ে না শোয়া। কেননা, হাদিসে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘এটা জাহান্নামীদের শোয়া।’ (ইবনে মাজাহ , ৩৭২৪ )। তিনি আরও বলেন: ‘এটা এমন শোয়া, যা আল্লাহতা’আলা পছন্দ করেন না।’ তিরমিজি, আহমাদ।
৫. এ সময় হাদিসে বর্ণিত যিকির বা দোয়াসমূহ পাঠ করা। মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা যখন শোয়ার জন্য বিছানা গ্রহণ করবে, তখন চৌত্রিশ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে, তেত্রিশ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে এবং তেত্রিশ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলবে। (মুসলিম)। এ সময় সূরা ফাতিহা ও আয়াতুল কুরসী পড়তে বলা হয়েছে। এভাবে আরও বহু হৃদয়গ্রাহী মাসনুন দুআ হাদিসে রয়েছে।
৬. ঘুমন্ত ব্যক্তি যখন সকালবেলায় উপনীত হবে, তখন নিম্নোক্ত যিকির বা দোয়াসমূহ পাঠ করবে: ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে বিছানা থেকে ওঠার পূর্বে বলবে: আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আহ’ইয়ানা বাদামা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুসূর। - সকল প্রশংসা সে আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দান করার পর পুনরায় জীবন দান করেছেন; আর তাঁরই নিকট (আমাদের) ফিরে যেতে হবে।’ (বুখারী)।
যখন তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার জন্য ঘুম ভাঙবে তখন সে আকাশের দিকে তাকাবে এবং সূরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত পাঠ করবে। কেননা, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: যখন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আমার খালা মাইমুনা রাদিয়াল্লাহু আনহার নিকট রাত্রি যাপন করি, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্ধরাত্রি কিংবা এর সামান্য পূর্ব অথবা সামান্য পর পর্যন্ত ঘুমালেন। তারপর তিনি ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন এবং দুই হাত দিয়ে মুখ থেকে ঘুমের আবেশ মুছতে লাগলেন; অতঃপর সূরা আলে ইমরানের শেষ দশ আয়াত পাঠ করলেন। তারপর ঝুলন্ত একটি পুরনো মশকের কাছে গেলেন এবং তা থেকে সুন্দরভাবে অযু করলেন। এরপর সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন।’ (বুখারী)।
ফজরে ঘুম থেকে ওঠার সময় চারবার এ দোয়া পাঠ করবে: হে আল্লাহ! আমি তোমার প্রশংসাসহ সকালবেলায় উপনীত হয়েছি, আমি সাক্ষী বানিয়েছি তোমাকে, তোমার আরশ বহনকারী ফেরেশ্তাদেরকে, তোমার সকল ফেরেশ্তাকে এবং তোমার সকল সৃষ্টিকে; নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহ, তুমি ছাড়া উপাসনারযোগ্য কোনো সত্য ইলাহ নেই; আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার বান্দা ও রাসূল)। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি তা (উপরিউক্ত দোয়াটি) একবার পাঠ করবে, আল্লাহ তাকে এক-চতুর্থাংশ জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেবেন; আর যে ব্যক্তি তা তিনবার পাঠ করবে, আল্লাহ তাকে তিন-চতুর্থাংশ জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেবেন; আর যে ব্যক্তি তা চারবার পাঠ করবে, আল্লাহ তাকে পুরাপুরিভাবে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দেবেন।’ (আবু দাউদ)।
আসুন, আমরা কুরআন হাদিসে বর্ণিত নিয়মের ধারাবাহিকতায় রাত-দিন, সকাল-সন্ধ্যা অতিবাহিত করি। তাহলে আমাদের ও এসব দিবসের স্রষ্টা রাব্বুল আলামীন আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন। আমরা তাঁর রহমতের বারিধারায় সিক্ত হব, দূর হবে আমাদের অসুস্থতা ভাগ্যের সংকীর্ণতা।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব
[email protected]